কক্সবাজারের রামু, উখিয়া এবং টেকনাফে বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ পল্লিতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের পার হলো এক যুগ। এসব ঘটনায় পৃথক দেড় ডজন মামলা হলেও সাক্ষীর অভাবে ১২ বছরেও শেষ করা যায়নি বিচার প্রক্রিয়া। অভিযুক্তরা জামিনে এসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে এখনো শঙ্কা ও আতঙ্ক কাটেনি এ সম্প্রদায়ের, এমনটি দাবি সংশ্লিষ্টদের।
অনেকে আবার সম্প্রীতি ফিরে আসার কথাও জানান। সাক্ষীর অভাবে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেছেন সরকারি আইনজীবী (পিপি) সৈয়দ রেজাউর রহমান। এদিকে, রামু ট্র্যাজেডির ঘটনায় মূল অভিযুক্তদের শনাক্ত ও বিচার নিশ্চিতের দাবিতে বৌদ্ধ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কক্সবাজারের রামু লালচিং-সাদাচিং-মৈত্রবিহার প্রাঙ্গণে প্রতিবাদী মানববন্ধন করে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ।
উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহারের অধ্যক্ষ বিজয় রক্ষিত মহাথেরোর সভাপতিত্বে এ মানববন্ধনে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের সভাপতি কেতন বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক বিপুল বড়ুয়া আব্বু, রাজেন্দ্র বড়ুয়া, বিমল বড়ুয়া, প্রাবন বড়ুয়া প্রমুখ বক্তব্য দেন। এর আগে সংঘদান, অষ্ট পরিষ্কার দান, ধর্ম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও বিকেলে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার থেকে মৈত্রী শোভাযাত্রা বের হয়ে সীমা বিহারে দেশ, জাতির মঙ্গল ও সমৃদ্ধি এবং জগতের সব প্রাণীর সুখ-শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
রামু উপজেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি রিটন বড়ুয়া বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ পরিষদের আয়োজনে দুপুরে বিশ্ব শান্তি কামনায় ‘সংঘদান’ অনুষ্ঠানের পর বিকেল ৩টায় বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের আয়োজনে কেন্দ্রীয় সীমা বিহার থেকে শান্তি র্যালি বের হয়ে প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে বাইপাস হয়ে সীমাবিহারে এসে শেষ হবে। যেখানে জেলার টেকনাফ, উখিয়া এবং চকরিয়া থেকে সম্প্রদায়ের লোকজন অংশ নেবেন।
তথ্য মতে, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে উত্তম বড়ুয়া নামে এক যুবক পবিত্র কোরআন অবমাননা করেছে এমন গুজবের জেরে রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধবিহার এবং বৌদ্ধপল্লির ২৬টি ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হামলা চালানো হয়। এ ঘটনার জের ধরে পরদিন উখিয়া ও টেকনাফের আরও সাতটি বৌদ্ধবিহার পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। মামলায় ৩৭৫ জনের নাম উল্লেখসহ আসামি করা হয় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে। পরে একটি মামলা প্রত্যাহার করা হলেও ১৮ মামলায় ৯৯৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে চার্জ গঠনের পর সাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। এদিকে ঘটনার পর থেকে আজও খোঁজ মেলেনি উত্তম বড়ুয়া নামের ওই যুবকের।
উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়া ও মা মাধু বড়ুয়া বলেন, ঘটনার পর থেকে উত্তম কোথায় আছে, তা জানেন না তারা। অপেক্ষায় আছেন ছেলে একদিন ফিরে আসবে।
রামু উপজেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি রিটন বড়ুয়া বলেন, হামলার ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে তাদের অনেককে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার হামলায় জড়িত নেই এমন অনেকে আসামি হয়েছেন। তাই সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন।
রামু কেন্দ্রীয় জাহাজ ভাসা ও প্রতারণা উদযাপন পরিষদ সভাপতি মিথুন বড়ুয়া বোথাম বলেন, আমরা এখনো হামলার শঙ্কামুক্ত নই। আমাদের প্রত্যাশা ২০১২ সালের সে ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটুক। তাই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।
রামুর বাসিন্দা ও সাংবাদিক অর্পণ বড়ুয়া বলেন, ওই ঘটনায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের পরিবর্তে মামলার বাদী হয়েছে পুলিশ, তদন্তও করেছে পুলিশ। এতে ইচ্ছেমতো আসামি করে অভিযোগপত্র থেকে বাদও দিয়েছে। যার ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণ ও প্রকৃত আসামিদের অনেকে আড়াল হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সৈয়দ রেজাউর রহমান রেজা বলেন, আমি পিপি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি ৩ মাস হবে। ইতোমধ্যে আমি সব অতিরিক্ত পিপি, সহকারী পিপিদের নিয়ে বসে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে সবাইকে আন্তরিক হতে অনুরোধ করেছি। বৌদ্ধ মন্দিরে মামলার ঘটনায় দায়ের মামলাগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও আলোচিত ১৮টি মামলার মধ্যে প্রায় ৯০০ আসামি ও ১৬০ জনের মতো সাক্ষী আছেন। মামলাগুলো বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। আমরা চেষ্টা করছি তথ্য, প্রমাণ আর সাক্ষীর মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে। কিন্তু সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে বিচার প্রক্রিয়া একপ্রকার থমকে আছে। সাক্ষীদের নামে সমন জারি করা হয়েছে অনেকবার। সাক্ষীরা আদালতে এলে প্রয়োজনে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন পিপি।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ শীল প্রিয় মহাথের বলেন, রামুর ধর্মীয় সম্প্রীতি শত বছরের। দীর্ঘ বছরের ঐতিহ্যে নিমিষেই শেষ হয়। সে বিভীষিকাময় দিনের কথা স্মরণ হলে চোখে জল চলে আসে। এক যুগ পার হলেও আমরা জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারিনি। ভিডিও ও ছবি দেখে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তবে, আমরা পুরোনো সম্প্রীতির বন্ধনে আবারও আবদ্ধ হয়েছি।