আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ভোট আগামী ৭ জানুয়ারি। তার আগেই মনোনয়নপত্র দাখিল, বাছাই, প্রার্থিতা প্রত্যাহার এবং প্রতীক বরাদ্দের কাজ সম্পন্ন করবে নির্বাচন কমিশন।
তফসিল ঘোষণার পর থেকেই সরকারের কার্যক্রমে পরিবর্তন চলে আসবে। সংবিধান কিংবা আইনে স্পষ্ট কিছু না থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চর্চা অনুযায়ী তফসিলের পর পূর্ববর্তী সরকারই বহাল থাকবে, যা নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে বিবেচিত হবে।
এ সরকার রুটিন বা স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাবে। কোনো নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে না বা নতুন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করবে না। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যেও এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
তবে মন্ত্রিসভায় থাকা তিনজন টেকনোক্র্যাট (সংসদ সদস্য নন) মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় না থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া সরকারের যেসব মন্ত্রী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন, তাদের সুযোগ-সুবিধা কিছু কমবে। নির্বাচনী প্রচারকাজে তারা সরকারি প্রটোকল পাবেন না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান সরকার এভাবেই কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।
গতবারের মতোই থাকছে এবারের নির্বাচনকালীন সরকার। যদিও এর আগের বারের নির্বাচনকালীন সরকারে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দুজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ছাড়া বাকি সবার স্থান হয়েছিল নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায়।
তফসিলের পর বর্তমান সরকার শুধু রুটিন কাজ চালিয়ে যাবে, কোনো নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। কোনো নতুন প্রকল্পও উদ্বোধন করতে পারবে না। এজন্য গত কিছুদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ হওয়া বড় প্রকল্পগুলো উদ্বোধনে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। এসময়ের মধ্যে নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছেন তিনি।
‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২’ অনুসারে গতকাল বুধবার (১৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় তফসিল ঘোষণার পরপরই শুরু হয়েছে ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’। নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষে ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত এই ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ বহাল থাকবে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ৫(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় যে কোনো দায়িত্ব পালনে বা সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দিতে পারবে। ৪৪(ঙ) অনুচ্ছেদ অনুসারে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তাকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া বদলি করা যাবে না। এছাড়া নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনবোধে যে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলির ব্যবস্থা নিতে পারবে। ‘নির্বাচন কমিশন এ সময় নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১’ প্রয়োগ করতে পারবে।
গত ৩১ অক্টোবর গণভবনে ব্রাসেলস সফর নিয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বাদশ সংসদের ভোটের আগে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা জানান।
ওই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও কানাডার মতো সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে যেভাবে নির্বাচনকালীন সরকার থাকে, সেভাবে চলবে। অর্থাৎ সেসময় আমরা যারা থাকবো, আমরাই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে আমাদের রুটিন ওয়ার্ক পালন করবো, যেন সরকার অচল হয়ে না যায়, সেটা আমরা করবো, সেভাবেই চলবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের আরপিও অনুযায়ী যখন নির্বাচনের সময় ঘোষণা হবে, মনোনয়নপত্র দাখিল হবে, তখন থেকে আর সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা মন্ত্রীরা ব্যবহার করতে পারবে না, পতাকা বা কোনো সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না। তখন একজন প্রার্থী হিসেবেই তাদের ভোট চাইতে হবে।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা ছোট করা হলেও এবার তেমন পরিকল্পনা নেই বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২০১৪-তে আমি কিছু মন্ত্রী অন্যান্য দল থেকে নিয়োগ করেছিলাম, এরপর ২০১৮-তে সেই পদ্ধতি করি নাই, যেটা অন্যান্য দেশে হয়- এবারও সেভাবে হবে।
‘এবারও প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারণা শুরু হলে মন্ত্রীরা আর সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করবেন না। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে নির্বাচনী প্রচারণার কাজ। এই নির্বাচনী প্রচারণার সময় কোনো মন্ত্রী কোনো ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে না আর কোনো রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না’, এটাই নিয়ম বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সরকার থেমে থাকবে না, সরকারি দৈনন্দিন যে কাজগুলো, রুটিন ওয়ার্ক যাকে বলে, সেটা কিন্তু করতে হবে। নইলেতো স্থবির হয়ে যাবে, দেশতো চলবে না। কাজগুলো যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, আমাদের উন্নয়নের ধারাটা যেন অব্যাহত থাকে, আমাদের সেটাই প্রচেষ্টা। সেজন্য বলছি, যেভাবে আছে সেভাবে (থাকবে)।
বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, যেহেতু গতকাল তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে, তাই তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী কাজকর্ম নির্বাচন কমিশন দায়িত্বশীলভাবে করবে। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী কাজে যেসব সরকারি বিভাগ, সংস্থা বা অফিস তাদের প্রয়োজন হবে এবং নির্বাচন প্রভাবিত হবে না সেসব কাজ করবে যে সরকার আছে সেই সরকার। এ সরকার রুটিন কাজগুলো করে যাবে।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এখন থেকে রুটিন কাজ করে যাবে। পলিসি ডিসিশন (নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত) নেওয়া হবে না, কারণ একটা নির্বাচন আছে। জনগণের কাছে আমাদের ম্যান্ডেট দেব। নির্বাচন পর্যন্ত রুটিন কাজ করে যাবো।
সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বলে কিছু নেই জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, ব্যাপারটা হচ্ছে গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে চালিত করার জন্য নির্বাচনকালীন সময়ে যে সরকার থাকে তারা পলিসি ডিসিশন নেয় না, যেন একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে। তারা এমন কিছু করে না, যা সরকারকে জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য, আকৃষ্ট করার জন্য কিছু করছে এরকম একটা ব্যাপার হয়।
বর্তমান মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধীদলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার স্থায়ীভাবে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। পরে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়।
এরপর ২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বিদ্যমান সরকারই এ দুটি নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীসহ ২৯ সদস্যের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এরমধ্যে ২১ জন মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ৭ জন। ওই মন্ত্রিসভায় মহাজোট সরকারের ১৬ মন্ত্রী ও ১৪ জন প্রতিমন্ত্রী বাদ পড়েন। নিয়োগ দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর আরও দুই উপদেষ্টা।
নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর মন্ত্রিসভা বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তারিখবিহীন পদত্যাগপত্র জমা দেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা। রাষ্ট্রপতি যে পদত্যাগপত্রগুলো গ্রহণ করেন তারাই নির্বাচকালীন সরকারে স্থান পাননি। ওই মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জাসদের ৬ জন মন্ত্রী ও দুজনকে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ওই বছরের ৮ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন। ওইদিনই বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে চার মন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পদত্যাগপত্র জমা দেন। তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয় একমাস পর, অর্থাৎ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর ঠিক আগের দিন।