দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) শতাধিক স্থানীয় সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে। প্রথম দফায় নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৬৭টি বেসরকারি সংস্থাকে। আজ রবিবার নিবন্ধনের জন্য আরও প্রায় ৫০টি সংস্থাকে বাছাই করার কাজ সম্পন্ন হতে পারে। সব মিলিয়ে এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ১১৭টির কাছাকাছি। ইসির রোডম্যাপে এ নির্বাচনে স্বচ্ছতার প্রয়োজনে পর্যাপ্তসংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো আগের দুটি নির্বাচনের মতো এবারও হাত গুটিয়ে রাখতে পারে। তহবিল সংকটের কারণে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোর নির্বাচনকেন্দ্রিক মৌসুমি ব্যবসা এবারও জমবে না। তার পরও অনভিজ্ঞ নতুন সংস্থাগুলো তহবিল পাওয়ার আশায় নিবন্ধন নিয়ে রাখছে। এর আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তহবিল সংকটের কারণে ইসিতে নিবন্ধিত বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং বর্তমানে নিষ্ক্রিয় ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) সাবেক পরিচালক ড. মো. আবদুল আলীম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচন ‘বিশ্বাসযোগ্য ও প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক’ না হলে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো তহবিল দেয় না। আর দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তহবিল না পেলে স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর এমন সক্ষমতা ও ইচ্ছা নেই যে নিজস্ব তহবিল দিয়ে নির্বাচনী মাঠে পর্যবেক্ষক নামাবে।
তিনি বলেন, দেশের এনজিওগুলো মূলত ক্ষুদ্রঋণ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাÑ এসব নিয়ে কাজ করে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টি তাদের অনেকটা মৌসুমি ব্যবসা। নির্বাচন এলে অর্থ সহযোগিতা প্রাপ্তি সাপেক্ষে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এই বাস্তবতায় আসলে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর স্বতন্ত্র কোনো অবস্থান নেই।
বগুড়াভিত্তিক এনজিও ‘লাইট হাউজ’-এর নির্বাহী পরিচালক হারুন-উর রশিদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তহবিল সংকটের কারণে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারিনি। দাতা সংস্থাগুলোর তহবিল পেতে এনজিও ব্যুরোর অনাপত্তিপত্র পাওয়া যায়নি। সে কারণে এবার নিবন্ধন পেতে ইসিতে আবেদনও করিনি। কারণ অন্য খাত বা নিজেদের টাকায় পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়।
মেহেরপুরভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি (পিএসকেএস) ২০১৮ সালেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কাজ ছেড়েছে এবং এবারও নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করেনি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, গত সংসদ নির্বাচনেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নির্বাচনের কোনো কাজে জড়িত থাকব না।
তিনি আরও জানান, বিদেশি অনুদানপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করেই মূলত আমাদের মতো এনজিওগুলো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে থাকে এবং সে লক্ষ্যেই নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন নেয়। অনুদান না পেলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয় না। কোনো কোনো সংস্থা অনুদান না পেলেও হয়তো ইসিতে নিবন্ধন টিকিয়ে রাখার জন্য নামমাত্র পর্যবেক্ষণের নামে বা অনুদান পাওয়ার আশায় নিবন্ধন নিচ্ছে।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর মতে, বেশিরভাগ বেসরকারি সংস্থার কাছে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টি হচ্ছে ‘মৌসুমি ব্যবসা’। নির্বাচন এলে দাতা সংস্থার কাছ থেকে তহবিল পাওয়া গেলে কাজ করবÑ এই চিন্তাভাবনা থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে রাখে। তহবিল না পেলে এসব সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পাওয়া যায় না। আবার দাতা সংস্থাগুলো তহবিল দিতে চাইলেও সরকার যদি অনুমোদন না দেয় তখনও একই সমস্যা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ সমস্যা হয়েছিল। আর এবার দাতা সংস্থাগুলো নির্বাচন পর্যবেক্ষণে তহবিল দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সংস্থাটির পক্ষে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর যে আর্থিক বিষয় ছিল তা নামঞ্জুর করা হয়েছে।
তহবিল প্রাপ্তি নিয়ে গতবার যা হয়েছিল
গতবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের ২২টি সদস্য সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। বিদেশি তহবিল পেতে এনজিও ফোরামের কাছে অনাপত্তিপত্র পায় সাতটি সংস্থা। ফলে ১৫টি সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারেনি।
বিদেশি অনুদানের অর্থ ছাড়ের জন্য এনজিও ব্যুরো থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। এনজিও ব্যুরোর অনাপত্তিপত্রের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র লাগে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো সাধারণত দাতা সংস্থার কনসোর্টিয়াম থেকে এশিয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকে।
নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ও মো. আবদুল আলীম জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইডব্লিউজি থেকে ৩০০ আসনে ১৫ হাজার পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ইডব্লিউজিভুক্ত সব সংস্থা তহবিল না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত পাঁচ হাজার পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘ওই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। বিএনপি ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলো একেবারে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেয়। এ কারণে তহবিল প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তার সঙ্গে আমাদের প্রস্তুতিরও ঘাটতি ছিল।’
গত চার নির্বাচনে যত পর্যবেক্ষক
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, ২০০১ সালের নির্বাচনে ২ লাখ ১৮ হাজার স্থানীয় এবং ২২৫ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ২০০৮ সালে স্থানীয় পর্যবেক্ষক ছিলেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ১১৩ জন এবং বিদেশি ৫৯৩ জন।
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে স্থানীয় পর্যবেক্ষক ছিলেন ৮ হাজার ৮৭৪ জন। বিদেশিদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলোর ফোরাম ফেমবোসার সদস্য হিসেবে ভারত ও ভুটানের দুজন করে চারজন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ১১৮টি স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার মধ্যে ৮১টির ২৫ হাজার ৯২০ জন পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে সবাই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ছিলেন না।
এবারের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় ইসিতে নিবন্ধিত পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা ১১৭টি থাকলেও মাত্র তিনটি সংস্থার ৯০ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি নেন।
দ্বিতীয় দফায় নিবন্ধন পেতে পারে আরও ৫০ সংস্থা
নির্বাচন কমিশন গত ১৮ জানুয়ারি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করে। নির্ধারিত সময়ে ১৯৯টি এবং পরে ১১টিসহ মোট ২১০টি বেসরকারি সংস্থা আবেদন করে। চূড়ান্ত বাছাইয়ে টিকে থাকা ৬৮টি সংস্থার তালিকা প্রকাশ করা হয় গত ৮ আগস্ট। এসব সংস্থার ওপর দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে নিবন্ধন দেওয়া হয় ৬৭টিকে; যেগুলোর ৪২টিই নতুন এবং নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম যোগ্যতাÑ গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার অভিজ্ঞতাও নেই। গত সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত ছিল এমন পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা ২৬।
এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিবন্ধিত পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়ে আগ্রহী সংস্থাগুলোর কাছে নজিরবিহীনভাবে দ্বিতীয়বারের মতো আবেদন চাওয়া হয়। এ বিষয়ে ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রথম দফায় নিবন্ধিত এত কমসংখ্যক সংস্থার পক্ষে ৩০০ আসনে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এ জন্য আবারও আবেদন চাওয়া হয়েছে।
ইসির জনসংযোগ শাখা থেকে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানানো হয়, দ্বিতীয় দফায় ১৪৯টি সংস্থা আবেদন করেছে। প্রথম দফায় বাছাইয়ে বাদ পড়া অনেক সংস্থাও আবেদন করেছে। এসব সংস্থার মধ্যে ৫০টির মতো বাছাইয়ে টিকতে পারে। আজ রবিবার এটি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। সুত্র: প্রবা