আঙ্কারা: ১৫ জুলাই শুক্রবার রাতে যখন প্রথম তুরস্কে অভ্যুত্থানের খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন কয়েক ঘণ্টা ধরে দেশটির নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহী সেনাদের হাতে বলেই মনে হচ্ছিল।
রাজধানী আঙ্কারা আর সবচেয়ে বড় নগরী ইস্তাম্বুলের প্রধান স্থাপনাগুলোতে ছিল তাদের দৃশ্যমান উপস্থিতি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দখল করে নেয় সেনাবাহিনী এবং তাদের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়।
এত ঘটনার মধ্যে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের।
অভ্যুত্থানকারীদের সেই মুহূর্তে দরকার ছিল সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অংশের এবং জনগণের সমর্থন।
কিন্তু অভ্যুত্থানের চেষ্টা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলডিরিম তা প্রতিরোধের চেষ্টা শুরু করেছেন।
তবে তুরস্কের বেশিরভাগ মানুষ জানে, প্রকৃত ক্ষমতা আসলে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের হাতে, এবং কিছু করতে হলে তাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।
অভ্যুত্থান সফল হতে হলে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। শুরুতে বোঝা যাচ্ছিল না প্রেসিডেন্ট এরদোগান কোথায় আছেন। কোনো কোনো খবরে বলা হচ্ছিল তিনি তুরস্কের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে এজিয়ান সাগর তীরের অবকাশ কেন্দ্র মারমারিসে আছেন।
কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে দেখা গেল সিএনএন এর তুর্কী ভাষার নিউজ চ্যানেলে। মোবাইল ফোনে ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি জনগণকে রাস্তায় নেমে অভ্যুত্থান প্রতিহত করার ডাক দিলেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান যখন ইস্তাম্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে এসে নামেন, হাওয়া পুরো ঘুরে গেলো।
সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি কড়া ভাষায় অভ্যুত্থানকারীদের দেখে নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিলেন, বললেন, তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই।
অনেকের কাছেই পরিস্কার হয়ে গেল যে, অভ্যুত্থানকারীরা ব্যর্থ হয়েছে, সিনিয়র সেনা অধিনায়করা সরকারের পক্ষেই আছে।
আঙ্কারার নিয়ন্ত্রণ তখনো অভ্যুত্থানকারীদের হাতে। কিন্তু ইস্তাম্বুল তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ তখন ইস্তাম্বুল আর আঙ্কারার রাস্তায় নেমে এসেছে। বিমানবন্দরে যে সেনারা অবস্থান নিয়েছিল, তাদের ঘেরাও করে জনতা, পুরো বিমানবন্দর দখল করে নেয় তারা।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন টিআরটি থেকে অভ্যুত্থানকারীরা বেশ কিছু ঘোষণা প্রচার করেছিল। তারা কারফিউ জারি করেছিল। কিন্তু সেটি কার্যকর করতে তারা ব্যর্থ হয়। অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হতে থাকে।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান যে হোটেলে ছিলেন সেখানে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান। ফলে সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
১৫ জুলাই রাতে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলে রাস্তায় নামে অভ্যুত্থান চালাতে। বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেওয়ায় পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। ওই রাতে দাবার আসল ঘুঁটির চাল দেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। অবকাশ যাপনে থাকা এরদোগান মোবাইল থেকে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বার্তা পাঠান।
ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) সমর্থকেরা তার আহ্বানে রাস্তায় নেমে আসেন। ওই দিন রাতে সিএনএন-টার্কের নারী সংবাদদাতা হ্যান্ডে ফিরাতের মাধ্যমে বার্তা পাঠান এরদোগান। সেই রাতের কথাই তিনি জানিয়েছেন বার্তা সংস্থা এএফপিকে।
সাংবাদিক ফিরাত সিএনএন টার্কের আঙ্কারার ব্যুরোপ্রধান। গত ১৫ জুলাই অভ্যুত্থান রাতের ওই ফোন কলের কারণে দেশটিতে এখন জাতীয় আইকন তিনি। ওই রাতের তুর্কি প্রেসিডেন্টের ফোন পাওয়ার পর থেকেই ফিরাতের মোবাইল সেটটিও অন্যদের কাছে বেশ সাড়া ফেলেছে।
সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে ফিরাত বলেন, ‘টেলিভিশনে লাইভ অনুষ্ঠান প্রচারের সময় মোবাইল পর্দায় দেখতে পাই প্রেসিডেন্ট জীবিত। এরপরই আমি প্রেসিডেন্টের বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিলাম।’ ফোন পেয়ে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে আমি বললাম, ‘হ্যালো? দয়া করে বলুন মি. প্রেসিডেন্ট, আমরা আপনার কথা শুনছি…।’ ‘শুভ সন্ধ্যা!’ ‘শুভ সন্ধ্যা, স্যার, দয়া করে বলুন…।’
এরদোগান তার মোবাইলের অ্যাপল অ্যাপ ফেসটাইমের মাধ্যমে সিএনএন-টার্কের নারী সংবাদদাতা হ্যান্ডে ফিরাতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হ্যান্ডে ফিরাত তার অফিসের মোবাইলে দেখতে পান প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মুখ। মোবাইলে তিনি অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে তার সমর্থকদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। এরদোয়ানের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন তার সমর্থকেরা। সংকটময় সন্ধিক্ষণে এই আহ্বান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল।
ফিরাত ইস্তাম্বুলে এক সাক্ষাৎকারে এএফপিকে বলেন, ‘আমি আমার ফোন বিক্রি করতে পারিনি। এটা আমি আমার ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি এবং এটা মাঝে মাঝে বেজে ওঠে। হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আমি ফোনটি ব্যবহার করি না।’ তুরস্কে অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিতে সাহায্য করা এই ফোন ফিরাতের কাছ থেকে সৌদি আরব, কাতার এবং তুরস্কের ব্যবসায়ীরা কিনতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি বিক্রি করেননি।
গত ১৫ জুলাই রাতে তুরস্কের রাষ্ট্র পরিচালিত প্রচারমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহী সেনারা। সেনারা টেলিভিশনে সারা দেশে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে দাবি করে একটি বিবৃতি পড়ে শোনাতে বাধ্য করে। রাতের ওই অভ্যুত্থানের পরে রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের ব্যাপারে কিছু জানা যাচ্ছিল না। কারণ তিনি পরিবারের সঙ্গে সাগরপাড়ে অবকাশ যাপনে ছিলেন।
সিএনএনের তুর্কি ভাষার টেলিভিশন স্টেশন সিএনএন টার্ক দোগান মিডিয়া গ্রুপের মালিকানাধীন জনপ্রিয় একটি চ্যানেল। এই চ্যানেলের সঙ্গে এরদোগানের সম্পর্ক মাঝে মাঝে অস্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছে যায়। কিন্তু এরপরও ফোন করার জন্য তিনি বেছে নেন সেই সিএনএন টার্ককেই।
ফিরাত বলেন, ‘ওই কল যখন আসে, তখন অতীতের সম্পর্কের কথা চিন্তা না করে শুধু সাক্ষাৎকারের ওপর ধ্যান দিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘আমি যখন লাইভে ছিলাম, তখন খুব ভিতসন্ত্রস্ত এবং চিন্তিত ছিলাম। সেই মুহূর্তে আমার ধ্যান ছিল কাজ। কোনো কিছু ভাবার আগেই মোবাইল পর্দায় দেখতে পাই প্রেসিডেন্ট জীবিত। আমি কাজের ওপর নজর দিলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি।’
ওই সাক্ষাৎকার প্রচারের পর রীতিমতো হইচই ফেলে দেওয়া ফিরাত বলেন, ‘আমার হাত কাঁপছিল, ক্যামেরায় তাকে (এরদোগানের) পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল, এ সময় কোনো প্রশ্ন করা উচিত কি না, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।’
ওই রাতে তুরস্কের বিশৃঙ্খলা, রাজধানীতে বোমা-গুলি, আকাশে জেট বিমানের আনাগোনা, সেনা সংঘর্ষ নানান কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন ফিরাত। তিনি খোদার উদ্দেশে বলেন, ‘আমার দেশ অন্য এক দেশ হয়ে উঠছে? দেশে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে? পরদিনের সকালটি আমরা কীভাবে শুরু করব?’
এরদোগানের বেপরোয়া ওই ফোন কল ও সাক্ষাৎকার সিএনএন টার্ক প্রচার করার পরই নাটকীয়ভাবে তার ভাগ্য বদলে যায়। অনিশ্চয়তা শেষে তিনি ইস্তাম্বুল পৌঁছান এবং পরদিন সকালে অভ্যুত্থান ভেস্তে যায়। ওই সাক্ষাৎকার প্রচারের পরই বিদ্রোহী সেনারা সিএনএন টার্কের কার্যালয়ে হানা দেয়। এরপরই সিএনএন টার্কের টিভি পর্দা কালো হয়ে যায় এবং মাঝে মাঝে গোলাগুলি ও কামানের শব্দ শোনা যায়।
তবে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পরই ওই চ্যানেল আবার প্রচারে ফিরে আসে। এরপরই এরদোগানের সঙ্গে ফিরাতের সেই সাক্ষাৎকার বারবার দেখানো শুরু হয়। ওই সাক্ষাৎকার দুই দিন ধরে প্রচারিত হয়।
এরদোগান দেশের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার পরই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। বিদ্রোহী সেনা ও এর সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন। গ্রেপ্তার করা হয় ৩৭ হাজার জনকে।
ফিরাত বলেন, ‘ওই কলের প্রভাব তুরস্ক ও অন্যত্র রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি পরদিন এর প্রভাব উপলব্ধি করি।’ তিনি বলেন, ‘আমি আরব বিশ্ব থেকে অনেক বার্তা পেয়েছি। তারা আমার টুইটার অ্যাকাউন্টে বলছে ‘ধন্যবাদ’, ‘এটাই একটি ফোনের স্বাধীনতা’ এবং ‘তুমি এ অঞ্চলের ভাগ্য পরিবর্তন করেছ’।’
অত্যধিক প্রচার তার কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছিল কি না—এর উত্তরে ফিরাত বলেন, ‘মাঝেমধ্যে আমি এটা চিন্তা করি…কিন্তু আমি জানি যে এটা আমার কাজ এবং ওই রাতে আমি সত্যটা তুলে ধরতে চেয়েছি।’
এই নারী সাংবাদিক ১৯৭৪ সালে আঙ্কারার ডাডুগদু এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি সিএনএন তুর্ক টেলিভিশনের আঙ্কারার ব্যুরো চীফ হিসেবে কর্মরত আছেন।
এএফপি অবলম্বনে
পাঠকের মতামত