কালের কন্ঠ::
করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকা সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়ই সময় না বাড়িয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ করার ব্যাপারে প্রায় একমত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে স্কুল খোলা সম্ভব হলে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হবে। আর সেটা সম্ভব না হলে ‘অটো পাস’ দেওয়া হবে। উভয় ক্ষেত্রেই পাঠ্য বই বা সিলেবাসের যে অংশটুকু পড়ানো সম্ভব হবে না তার অত্যাবশ্যকীয় পাঠ পরের শ্রেণিতে যুক্ত করা হবে। শিক্ষার এই ‘রিকভারি প্ল্যান’ চূড়ান্ত করতে আগামীকাল বুধবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে।
তবে নভেম্বরের মধ্যে স্কুল খোলা সম্ভব হলে ডিসেম্বরেই সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রতিটি স্কুল থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মেধাবী শিক্ষার্থী নিয়ে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে। তবে সব বিষয়ের পরীক্ষা না নিয়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রাথমিকের ‘রিকভারি প্ল্যান’ তৈরি করেছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)। আর মাধ্যমিকের ‘রিকভারি প্ল্যান’ তৈরি করেছে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বিইডিইউ)। এরই মধ্যে উভয় সংস্থাই তাদের পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতেই আগামীকাল এনসিটিবিতে বৈঠক ডাকা হয়েছে। প্রয়োজন হলে এনসিটিবি প্রতিটি শ্রেণির ‘কারিকুলাম ম্যাপিং’ করে ‘রিকভারি প্ল্যান’ চূড়ান্ত করবে।
বিইডিইউয়ের ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ (পরীক্ষা ও মূল্যায়ন) রবিউল কবীর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে এই বিষয়েবলেন, ‘সেপ্টেম্বরে স্কুল খুললে কিভাবে পরবর্তী কার্যক্রম চলবে, অক্টোবরে বা নভেম্বরে খুললে কিভাবে চলবে সে ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত পরিকল্পনা জমা দিয়েছি। যদি নভেম্বরের মধ্যে স্কুল খোলা সম্ভব হয় তাহলে সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরীক্ষা নেওয়া হবে। সেটা সম্ভব না হলে আমরা অটো প্রমোশন দিতে বলেছি। আশা করছি, ডিসেম্বর নাগাদ করোনার ভ্যাকসিন চলে আসবে। সে ক্ষেত্রে নভেম্বর পর্যন্ত স্কুল খোলা সম্ভব না হলে ডিসেম্বরে বৃত্তির জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। প্রত্যেক স্কুল থেকে ৫ বা ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী এই পরীক্ষায় বসবে। এ ক্ষেত্রে কত শতাংশ বৃত্তি পরীক্ষা দেবে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে।’
এই ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘আমরা অষ্টম শ্রেণির কিছু বিষয়ের কারিকুলাম ম্যাপিং করেছি। এটা হচ্ছে, যেটা না শিখলেই নয় সে বিষয়গুলো চিহ্নিত করা। প্রয়োজনে এনসিটিবি সব শ্রেণিরই কারিকুলাম ম্যাপিং করবে। এরপর একটি বিষয়ের যে অংশটুকু গ্যাপ থাকবে সেই নির্দেশিকা শিক্ষকদের দেওয়া থাকবে। তাঁরা পরবর্তী শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের তা শেখাবেন। এ জন্য আগামী বছর ৪০ মিনিটের একটি ক্লাস ৫০ মিনিট করে নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া কিছু ছুটি কমিয়ে দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালানো যেতে পারে।’
বিইডিইউ বলছে, করোনাভাইরাসের ছুটির কারণে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৮৮টি কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে। ১৬ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মাত্র ৪১ দিন কর্মদিবস পেয়েছিল, কিন্তু এই সময়ে তেমন একটা লেখাপড়া হয়নি। যদি ১ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস শুরু করানো সম্ভব হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা ৬৬ দিন পাচ্ছে। আর ১ অক্টোবর থেকে ৫২ দিন কর্মদিবস থাকে। এই সময়েও ক্লাস শুরু করা সম্ভব হলে শীতকালীন ১০ দিনের ছুটি বাতিল করা বা কমানোর সুপারিশও আছে।
বিইডিইউ আরো বলছে, সেপ্টেম্বরে স্কুল খুললে সিলেবাস কমিয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষাই নেওয়া সম্ভব। তবে অক্টোবর বা নভেম্বরে খুললে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। আর সেটা সম্ভব না হলে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ‘অটো পাস’-এর মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণিতে চলে যাবে শিক্ষার্থীরা।
প্রাথমিকের ‘রিকভারি প্ল্যান’ চূড়ান্ত করতেই কয়েক দিন ধরে ময়মনসিংহে অবস্থিত নেপে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বৈঠক চলছে। নেপ মহাপরিচালক মো. শাহ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর দুই মাসে শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা সামনে রেখে কাজ চলছে। বয়স অনুযায়ী শিশুদের শিখনফল সামনে রেখে তৈরি করা এই পরিকল্পনায় অবশ্যই সিলেবাস সংক্ষিপ্ত হবে। এ ক্ষেত্রে পরবর্তী শ্রেণির জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ থাকবে আর কম গুরুত্বপূর্ণ পাঠ বাদ যাবে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডিসেম্বর মাসে শ্রেণি কার্যক্রম সমাপ্তির লক্ষ্য ধরে কারিকুলাম ও সিলেবাস মূল্যায়নের কাজ করছে নেপ। এ লক্ষ্যে দুটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। প্রথম পরিকল্পনায় ১ সেপ্টেম্বর শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্য ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় পরিকল্পনায় ১ অক্টোবর থেকে কার্যক্রম শুরুর কথা বলা হয়েছে।
নেপ বলছে, ১ সেপ্টেম্বরে ক্লাস শুরু করতে পারলে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস কার্যক্রম চলবে। বার্ষিক পরীক্ষা হবে ডিসেম্বরে। আর পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস চলবে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে হবে পিইসি পরীক্ষা। আর ১ অক্টোবর থেকে ক্লাস শুরু করা গেলে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হবে। সে ক্ষেত্রে বার্ষিক ও পিইসি পরীক্ষা কবে কোনটি নেওয়া হবে সেটা নির্ধারণ করবে মন্ত্রণালয়।
নেপের একজন কর্মকর্তা জানান, উভয় প্ল্যানের ক্ষেত্রেই তাঁরা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সিলেবাস কমানোর চিন্তা করেছেন। তবে পঞ্চম শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ সিলেবাস শেষ করে দেওয়া হবে, যেহেতু এসব শিক্ষার্থী আরেক স্তরে চলে যাবে। প্রাথমিকের সিলেবাস দক্ষতা অর্জন কেন্দ্রিক। লার্নিং আউটকাম বা শিখনফল অর্জনের সঙ্গে এটা জড়িত। এ কারণে পরের শ্রেণির পাঠের জন্য সিলেবাসের যে অংশ পড়ানো জরুরি সেটা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে রাখা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রিকভারি প্ল্যান নিয়ে আমরা কাজ করছি। যেহেতু কবে স্কুল খুলবে সেটি বলা যাচ্ছে না, তাই আমাদের পক্ষেও অনেক কিছু সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুব শিগগির আমরা রিকভারি প্ল্যান চূড়ান্ত করব। ডিসেম্বরের মধ্যেই চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’
সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে দুই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে শিক্ষার ‘রিকভারি প্ল্যান’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে বৈঠক হয়। সেখান থেকে ডিসেম্বরেই চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ করার কথা বলা হয়। প্রয়োজনে পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণের ব্যাপারে বলা হয়। দুই মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর খুব শিগগির আবারও বৈঠক করা হবে বলে জানা যায়।
করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কয়েক দফা ছুটি বাড়িয়ে তা ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়েছে। গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ১৫ দিন পর এই পরীক্ষা নেওয়া হবে বলে পরিকল্পনা রয়েছে।