ক্যাডার তৈরির জন্য তামিরুল মিল্লাতের মতো মাদ্রাসা গড়ে তুললেও বিতর্কিত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সারির কোনো নেতার সন্তানরা মাদ্রাসায় পড়ে না।তারা তাদের সন্তানদের দেশি বিদেশি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।
‘রাজনৈতিক এনজিওতে পরিণত হওয়া’ এই দলটির শীর্ষ নেতাদের ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের রায়ে আজীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কারাগারে মারা যাওয়া গোলাম আযম, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মতো যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতার ছেলেমেয়েরা মাদ্রাসায় পড়েননি। তাদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় দীক্ষিত করে বিলাসী-আয়েশী জীবনের দিকেই ঠেলে দেয়া হয়েছে।
গোলাম আযম: সদ্যপ্রয়াত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর অন্যতম গোলাম আযমের ছয় ছেলের একজনও মাদ্রাসায় পড়েনি। বড় সন্তান আব্দুল্লাহ হিল মামুন আল আযমী রাজধানীর খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার থেকে অর্থনীতিতে এমএ করেছেন। দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল্লাহ হিল আমিন আল আযমী খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশত্যাগ করে লন্ডনে নিটিং ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। তৃতীয় ছেলে আব্দুল্লাহ হিল মোমেন আল আযমী সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে এসএসসি ও রাজধানীর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিকম পাস করেছেন। চতুর্থ ছেলে আব্দুল্লাহ হিল আমান আল আযমী ১৯৭৫ সালে সিলেট সরকারি অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি, ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, সবার জন্য নির্ধারিত তারিখের এক মাস পর তিনি মিলিটারি একাডেমিতে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে কর্মরত অবস্থায় অবসরে যান। পঞ্চম ছেলে আব্দুল্লাহ হিল নোমান আল আযমী ঢাকা গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ হিল সালমান আল আযমী মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি। এরপর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স করেন।
মতিউর রহমান নিজামী: জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীকে মঙ্গলবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যুদ্ধাপরাধের রায়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তার ছোট ছেলে নাদিম তালহা এখনও ছাত্র হলেও বাকি পাঁচ সন্তানই প্রতিষ্ঠিত। সন্তানদের মধ্যে সবার বড় মেয়ে মোহসিনা ফাতেমা। তিনি পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তার স্বামী সাইফুল্লাহ মানসুর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে বিটিভির সংবাদ পাঠক ছিলেন। তবে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি আর সুবিধা করতে পারেননি। বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। বড় ছেলে ড. নাকিবুর রহমান পড়ালেখা করেছেন মালয়েশিয়ার আন্তজার্তিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ ভালই আছেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনাতে। দ্বিতীয় ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। রাবেয়া ভূঁইয়া একাডেমিতে আইন বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে লন্ডন গিয়ে বার-অ্যাট-ল’ ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনি। ছেলেদের মধ্যে কেবল নাজিব মোমেনই দেশে অবস্থান করছেন। তিনি বর্তমানে হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত। নিজামীর তৃতীয় ছেলে ডা. নাইমুর রহমান খালেদ। পড়াশোনা করেছেন পাকিস্তানের একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। ছোট ছেলে নাদিম তালহা মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ালেখা করছেন। নিজামীর এই ছেলেই কেবল এখনও ছাত্র। ছাত্র হলেও মানবতাবিরোধী আন্তজার্তিক ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে রয়েছে তার ব্যাপক বিরোধিতা। প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ট্রাইব্যুনালবিরোধী বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান নিজামীর এই ছেলে।
ছোট মেয়ে খাদিজা পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে লন্ডনের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। ছোট মেয়ের স্বামী ব্যারিস্টার নজরুল ইসলাম। তিনি এক সময় শিবির সেক্রেটারি ছিলেন। নজরুল ইসলাম বর্তমানে লন্ডনে আইন পেশায় নিয়োজিত।
নিজামীর স্ত্রী সামসুন্নাহার নিজামীও পিছিয়ে নেই। তিনি গুলশানে একটি ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে জামায়াতের নারী শাখার আমিরের দায়িত্ব পালনকারী নেত্রীও নিজামীর স্ত্রী সামসুন্নাহার নিজামী।
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ: জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবাই আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। বড় ছেলে আলী আহমেদ আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স সম্পন্ন করেন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। দ্বিতীয় ছেলে আহমেদ আহকিক রাজধানীর মগবাজার আইএস স্কুল কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা নেন। আরেক ছেলে আহমেদ মাবরুর আইএস স্কুল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করেন। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স করার পর আল মানারাত ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করেছেন। একমাত্র মেয়ে তামরিনা রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেন। আল মানারাত ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন একমাত্র মেয়েটি।
কাদের মোল্লা: শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর রায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলে পড়েছেন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। কাদের মোল্লার মেয়ে আমাতুল্লাহ পারভীন ইস্পাহানী গার্লস স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইডেন কলেজ থেকে অর্নাস ও মাস্টার্স করেছেন। বড় ছেলে হাসান জামিল এসএসসি পাস করেছেন বাদশাহ ফয়সাল স্কুল থেকে। তেজগাঁও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেছেন। আরেক ছেলে আমাতুল্লাহ সায়মিন এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন ইস্পাহানী স্কুল ও কলেজ থেকে। অনার্স করেছেন হোম ইকোনমিক্স কলেজ থেকে। একই কলেজে ফুড অ্যান্ড নিউট্রেশন বিষয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়ন শেষ করেছেন। সেজো ছেলে হাসান মওদুদ রাইফেলস্ পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করে মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। আরেক মেয়ে আফতুল্লাহ লারদীন ইস্পাহানী গার্লস স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করছেন। ছোট মেয়ে আমাতুল্লাহ নাজনীন ইস্পাহানী গার্লস স্কুল ও কলেজে অধ্যয়ন শেষে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ছেন।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান: জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তার ৫ ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে হাসান ইকবাল ওয়ামী এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন ন্যাশনাল ব্যাংক স্কুল ও কলেজ থেকে। ইসলামী ইউনিভার্সিটি থেকে মিডিয়া অ্যান্ড ম্যাস কমিউনিকেশনে অনার্স করেছেন, মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। অপর ছেলে হাসান ইকরাম এসএসসি ও এইচএসসি ন্যাশনাল ব্যাংক স্কুল ও কলেজ থেকে, অনার্সে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। আরেক ছেলে হাসান জামান এসএসসি ও এইসএসসি ন্যাশনাল ব্যাংক স্কুল থেকে, অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছেন মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটিতে। আরেক ছেলে হাসান ইমাম এসএসসি ও এইচএসসি ন্যাশনাল ব্যাংক স্কুল অধ্যায়ন করে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ অধ্যয়ন করছেন। আরেক ছেলে আহম্মদ হাসান জামান ও লেভেল পরীক্ষা দেবেন একাডেমিয়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে। মেয়ে আতিয়া মিরপুর লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে পড়ছে।
মীর কাশেম আলী: সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত জামায়াতের অর্থ যোগানদাতার শীর্ষনেতা ধনকুবের মীর কাশেম আলী। তার দুই ছেলে তিন মেয়ে। ছেলে মোহাম্মদ বিন কাশেম (সালমান) আল মানারাত ইংরেজি মিডিয়াম থেকে ও লেভেল এবং এ লেভেল করেছেন। এরপর পাকিস্তান ডেন্টাল কলেজে পড়েছেন। আরেক ছেলে মীর আহমেদ বিন কাশেম (আরমান) আল মানারাত থেকে ও লেভেল এবং এ লেভেল সম্পন্ন করেন। এরপর লন্ডনে বার এট ল’ সম্পন্ন করেছেন। মেয়ে হাসিনা তাইয়্যেবা অনার্স এবং মাস্টার্স করেছেন হোম ইকোনমিক্স কলেজ থেকে। অপর মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া আল মানারাতে স্কুল ও কলেজ থেকে ও লেভেল এবং এ লেভেল সম্পন্ন করার পর আল মানারাত ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছেন। আরেক মেয়ে তাহেরা হাসনিন আল মানারাতে অধ্যয়নরত।