অসংখ্য জনপ্রিয় গানের শিল্পী শাহনাজ রহমত উল্লাহ। কিন্তু হঠাৎ করেই গান থেকে তার দূরে সরে যাওয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছিল। তার গাওয়া গানের ভাষায়- ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, সে হারালো কোথায়, কোন দূর অজানায়?’
২০১৫ সালে বিবিসি বাংলার গান-গল্প অনুষ্ঠানে অর্চি অতন্দ্রিলার সাথে আলাপকালে বলছিলেন সেসব কথা।
১৯৫৩ সালে জন্ম নেয়া এই সুপরিচিত শিল্পী ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্তির সাথে সময় থাকতেই গান থেকে বিদায় নেন। কারণ হিসেবে সে সময় তিনি ‘ব্যক্তিগত চয়েজ (পছন্দ)’- এর কথা উল্লেখ করেন।
নিজের সংসার জীবনের গল্প তুলে ধরে শাহনাজ রহমত উল্লাহ বলেন,‘আমি সংসারকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার ৪২ বছরের ঘর।… বিয়ের পরে হাউজ ওয়াইফ হিসেবে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছি।’
পরবর্তীতে তিনি ওমরাহ করতে গিয়ে ধর্মপরায়ণ জীবনযাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেন।
তিনি বলেন,‘ওমরাহতে গিয়েই আমি চেঞ্জ (পরিবর্তন) হয়ে গেছি। ওমরাহ থেকে দেশে ফিরে আসার পর মনে হয়েছে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বো, শুধু মনে হয়েছে আমি রোজা রাখবো, শুধু মনে হয়েছে আমি পবিত্র কোরআন শরীফ পড়বো।’
তিনি আরো বলেন,‘শিল্পী হিসেবে আমার ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। ইমেজটা সুন্দর থাকতে থাকতেই আমি গান ছাড়তে চেয়েছিলাম। যাতে মানুষ মনে করে যে আর কয়টা গান উনি কেন গাইলেন না।’
মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই যে শিল্পীর সঙ্গীত জীবন শুরু হয়েছিল, এতদিন পরে এসে তার জন্য বিষয়টা কিভাবে দেখেছিলেন?
ওমরাহ করে আসার পর ধর্মীয় রীতিনীতি কঠোরভাবে মেনে চলার ব্যাপারে তিনি তার যুক্তিতে অবিচল ছিলেন। তিনি বলছিলেন,‘এটা (ওমরাহ করে আসার পর পরিপূর্ণ ধার্মিক হিসেবে জীবন যাপন করা) আমি মনে করি খুব ভালো হয়েছে। এটা আমার নিজস্ব চয়েজ।’
তবু কি মিস করতেন তিনি গানকে? এই প্রশ্নে উত্তরে তিনি বলেন,‘গানকে মিস করি মাঝে মাঝে। বাসায় একটু গুনগুন করি। স্বামীকে গান শুনাই। সে আবার অনেক বড় ভক্ত আমার। এখন তো সময় পারই হয়ে গেছে। এখন কোনো অসুবিধা হয় না।’
দ্বৈতগান বেশি না করার কারণ কী? এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন,‘আমাকে দেয়া হয়েছে বলে আমি একক গান করেছি। যেমন – ছবিতে আমি শুধু নায়িকার গান গেয়েছি। টেলিভিশনে যেমন আধঘণ্টা শুধু আমি সোলো (একক সঙ্গীত) গাইবো। রেডিওতে সেম (একই)।’
তিনি আরো বলেন,‘কন্টিনিউসলি একটি জুটির সাথে গান গাইলে পপুলার হয়। না হলে হবে কী করে? ডুয়েট গান আমি খুব কম গেয়েছি। সে জন্য জুটির প্রশ্ন উঠে না।’
দেশাত্মকবোধক গানের একাল-সেকাল
বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক গানের দিকটা ধরতে গেলে সবার আগেই চলে আসে শাহনাজ রহমত উল্লাহর নাম। স্বাধীনতা বা বিজয়ের মাসেই যেসব দেশাত্মবোধক গান বেশি শোনা যায় তার বেশির ভাগই সত্তরের দশকে রচিত।
সেই তুলনায় এখনকার দেশাত্মক গানগুলো সেভাবে পরিচিতি পায় না। এর ব্যাখ্যাটাও দিলেন তিনি।
খানিকটা দম নিয়ে তিনি বললেন,‘দেখুন যেসব দেশাত্মবোধক গানের কথা আমি বলেছি যেমন – একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়, কিংবা ধরুণ জয় বাংলা বাংলার জয়, এক তারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল। এসব গানের কথাগুলো রিচ (সমৃদ্ধ)।’
তিনি আরো বলেন,‘আজকাল আমার মনে হয় না দেশের গান কেউ খুব একটা করে। দেশের গানের যে মাধুর্য – তার জন্য এটা কঠিন ব্যাপার কিন্তু।’
তার সময়কার সেই স্মৃতিচারণ করে এই শিল্পী বলছিলেন,‘ওই ষাটের দশক আর ফিরে আসবে না। তখন সব কিছু জীবন্ত ছিল – গানের কথার সুর এবং সঙ্গীত যারা সৃষ্টি করেছেন সবাই এক একজন বিগ বিগ বস আমি বলবো।’
তখন যেভাবে গানের কথাগুলোতে সুর তুলে রেকর্ড করা হতো, সেটিও তুলে ধরেন।
তিনি বলেন,‘এত দামী কথা এবং গান – আমাদের সিস্টেমই আলাদা ছিল। যেমন দুদিন লাগতো গান উঠাতে। তিনদিনের মাথায় আমরা রেকর্ডিং করেছি, শুরু থেকে ভুল করেছি- ব্যস, আবার নতুন করে গাইতে হবে।’
তিনি আরো বলেন,‘আর এখন তো সবকিছু কম্পিউটারাইজড। কম্পিউটারের মধ্যে হচ্ছে। একটা লাইন আমি গাইলাম, ওটা কাট করে আবার দুই লাইন বানালাম, আবার তিন লাইন।’
শাহনাজ রহমত উল্লাহ বলেন,‘এতো তো সোজা আমাদের ছিল না। সুতরাং ওই যে সিস্টেম, ওই যে সময়, ওই যে চিন্তা-ভাবনা, এখন মনে হয় না খুব একটা পাওয়া যাবে।’
দেশের গানের কথা বললে শাহনাজ রহমত উল্লাহর নাম চলে আসে – বিষয়টি তুলতেই তিনি বলেন,‘একজন শিল্পী হিসেবে এটা অনেক ভালো লাগে যে একটা দেশের গান থেকে অনেক কিছু আমি জনগণকে বলতে পারি।’
জনপ্রিয় এই সঙ্গীত শিল্পী শনিবার রাতে মারা গিয়েছেন।
বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ৪টি গান তার গাওয়া
বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমত উল্লাহর গাওয়া ৪টি গান স্থান পেয়েছিল।
গানগুলো হলো – খান আতাউর রহমানের কথা ও সুরে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা ও আনোয়ার পারভেজের সুরে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ এবং ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’।
তার ভাই আনোয়ার পারভেজ ছিলেন সুরকার, তার আরেক ভাই নায়ক জাফর ইকবালও করতেন গান। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
পাঠকের মতামত