গাজীপুর জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা একই জমি দুবার অধিগ্রহণ করায় সরকারের ১০ কোটি ৫১ লাখ ৬২ হাজার ৩৬৬ টাকার ক্ষতি হয়েছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের চূড়ান্ত নিরীক্ষায় এ অনিয়ম ধরা পড়েছে। সংস্থাটির পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষার সময় নীতিমালা না থাকায় সরকারি অর্থ পড়ে থাকা, অধিগ্রহণ করা খাসজমির মূল্য জমা না হওয়া, অধিগ্রহণকৃত জমির টাকা পরিশোধের সময় ট্যাক্স না কাটা ও কম ট্যাক্স কাটা প্রভৃতি পাঁচ রকমের অনিয়মের কথা জানা গেছে। এসব কারণে সরকারের ৭৪৪ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকা নয়ছয় হয়েছে।
গুরুতর এ আর্থিক অনিয়মের জন্য ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি ডিসি অফিসের প্রধান হিসাব কর্মকর্তাকে চিঠি দেওয়া হলেও জবাব পাওয়া যায়নি। অধিগ্রহণ করা জমি আবার অধিগ্রহণ করে সরকারি অর্থ লোপাটের জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ ও লোপাটকৃত অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা করার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি গত বছর ১৪ জুলাই জাতীয় সংসদে পাঠানো হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার মধ্য থেকে ২৪টি কার্যালয়ের ২০১৭-১৮ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরের ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের বিপরীতে অনুষঙ্গিক খরচের হিসাবের ওপর নিরীক্ষণ হয়। ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিরীক্ষণ চলে। নিরীক্ষায় পাঁচটি খাতে ৭৪৪ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৪ টাকা ব্যয়ে অনিয়ম পাওয়া যায়। আট কারণে এসব অনিয়ম হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়ম বন্ধে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা ও সরকারি আদায় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিধিবিধান মেনে চলার সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ওই জমির ১ দশমিক ২১৬০ একর আবার অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণ বাবদ ১০ কোটি ৫১ লাখ ৬২ হাজার ৩৬৬ টাকা পরিশোধ করা হয়। বিষয়টি জানার পর অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না বলে বাতিলও করা হয়। কিন্তু যাদের জমি অধিগ্রহণের জন্য এ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে তা ফেরত পাওয়া যায়নি। টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য নোটিস হলে গাজীপুরের কড্ডা গোলটেকের বাসিন্দা আবদুল হাসেম মিয়া ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিট করেন।
রিটে তিনি টাকা ফেরত দেওয়ার নোটিস স্থগিত করার আর্জি জানান। আদালত শুনানি শেষে নোটিসের কার্যকারিতা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে। পরে স্থগিতাদেশ ২০১৮ সালের ২৩ মে একবার ছয় মাস ও ৫ নভেম্বর একবার এক বছর বাড়ানো হয়। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের মেয়াদ ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর শেষ হলেও টাকা আদায় করা হয়নি। এজন্য ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রধান হিসাব কর্মকর্তাকে চিঠি দেওয়া হলেও তার জবাব পাওয়া যায়নি। অধিগ্রহণ করা জমি আবার অধিগ্রহণ করে সরকারি অর্থ লোপাটের জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে লোপাট হওয়া অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের পরিচালক এসএম মাহমুদুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিরীক্ষা প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতীয় সংসদে পাঠানো হয়েছে। সংসদীয় কমিটি এটি দেখবে। ভূমি অফিসের বিষয়টি এখন রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের অধীন। তাই এ নথি সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়েছে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ১৪ নভেম্বর বিকেলে গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইশতিয়াক আহমেদকে ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোনকল ধরেননি।
নীতিমালা না থাকায় ৪৮৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা পড়ে আছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, যে সংস্থার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ ও অনুষঙ্গিক অর্থ আদায় করা হয়। এ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়। যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও অনুষঙ্গিক অর্থ কোষাগারে পড়ে রয়েছে। ২০২০ সালের রেজিস্ট্রার যাচাই করে দেখা গেছে, ২৩ ডিসি অফিসের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার ২০১৭-১৮ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুষঙ্গিক খরচের ৪৮৬ কোটি ৩১ লাখ ৬১ হাজার ২৪৬ টাকা কোষাগারে পড়ে আছে। এসব অফিসের মধ্যে রয়েছে টাঙ্গাইল, জামালপুর, গাজীপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, খুলনা, বরিশাল, ঝিনাইদহ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নরসিংদী, কুমিল্লা, রংপুর, গাইবান্ধা, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা আর কক্সবাজার ডিসি অফিসের অনুষঙ্গিক অর্থের পরিমাণ নিরীক্ষাকালে উপস্থাপন করা হয়নি। সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণীত না হওয়ায় এ অর্থ পড়ে আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
২৩৮ কোটি টাকা জমা হয়নি
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, খাসজমি অধিগ্রহণ করা হলে তার ক্ষতিপূরণের টাকা একটি নির্দিষ্ট কোডে জমা দিতে হয়। গাজীপুরসহ মোট ২৪টি ডিসি অফিসের ৮টি জেলার ভূমি অধিগ্রহণ শাখা খাসজমির ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাওনা ২৩৮ কোটি ৩ লাখ ৬১ হাজার ১০২ টাকা সংশ্লিষ্ট তহবিলে জমা দেয়নি, যা আর্থিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। যেসব জেলার ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় এ অনিয়ম হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা।
ট্যাক্স না কাটায় ৯ কোটির বেশি গচ্চা
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমি অধিগ্রহণকালে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া টাকা থেকে সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার জন্য ২ শতাংশ আর অন্য এলাকার জন্য ১ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। কিন্তু মোট ২৪টি ডিসি অফিসের তিনটির ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে ট্যাক্সের টাকা কাটা হয়নি। এতে সরকারের ৯ কোটি ১৬ লাখ ১১ হাজার ২৯২ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মাদারীপুর ডিসি অফিসের ৮ কোটি ৫৫ লাখ ১৪ হাজার ১২৮, গাজীপুর ডিসি অফিসের ৬০ লাখ ২২ হাজার ৯৮৭ ও শরীয়তপুর ডিসি অফিসের ৭৪ হাজার ১৭৬ টাকা। রাজশাহী ডিসি অফিস ট্যাক্স কম কাটায় ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৯৯৭ টাকা ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে সরকারের ৯ কোটি ৩০ লাখ ৫৪ হাজার ২৮৯ টাকা ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টি চিহ্নিত করে ডিসি অফিসের প্রধান হিসাব কর্মকর্তাকে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি চিঠি দেওয়া হলেও তার জবাব পাওয়া হয়নি। সুত্র: দেণরুপান্তর
পাঠকের মতামত