শাহেদ মিজান:
রাজধানী ঢাকা দিয়ে উৎপত্তি হওয়া চিকনগুনিয়া রোগটি এখন সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারেও। মহা আকারে না হলেও এরই মধ্যে এই রোগটি উল্লেখ করার মতো ছড়িয়ে পড়েছে কক্সবাজারে। বিশেষ করে জেলা শহরে এই রোগটি আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। গত এক মাস ধরে কক্সবাজারে এই চিকগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে অনেকে। আক্রান্ত অনেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এই প্রকোপ বাড়ছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। প্রকোপ বাড়ায় লোকজন চরম আতঙ্ক নিয়ে দিন যাপন করছে। চিকনগুনিয়া নিয়ে আজ মঙ্গলবার বৈঠক ডেকেছে কক্সবাজারের স্বাস্থ্য বিভাগ। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বৈঠকটি হওয়ার কথা রয়েছে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে গত এক মাস ধরে চিকনগুনিয়ার প্রভাব দেখা দিয়েছে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে জ্বরে আক্রান্ত ১০ জন রোগীর মধ্যে দু’জন চিকনগুনিয়া রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে। সে হিসাবে জ্বরে শতকরা ২০জন মানুষ চিকনগুনিয়া আক্রান্ত হচ্ছে।
এদিকে চিকনগুনিয়ায় আক্রান্তরা চিকিৎসা সদর হাসপাতালে আসলেও সেখানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। রোগীরা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে ছুটে যাচ্ছে সদর হাসপাতালে। কিন্তু জরুরী বিভাগে পারতপক্ষে জরুরী চিকিৎসা দিয়ে বিদায় করে দিচ্ছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে প্রেরণ করছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ৮০ শতাংশ রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) শাহীন আবদুর রহমান জানান, চিকনগুনিয়ায় আক্রান্তদের অধিকাংশ সময় পরিচর্যার মধ্যে রাখতে হয়। তাই রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বলছেন, মূলত রাজধানী ঢাকা থেকে চিকনগুনিয়া সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কক্সবাজারেও এই রোগের ভাইরাস ঢাকা থেকে চলে এসেছে। কক্সবাজারের সে সমস্ত মানুষ ঢাকা আসা-যাওয়া করছে তারাই এই ভাইরাসটি বহন করে নিয়ে আসছে। সেখানে মশার কামড় খেয়ে ভাইরাসটি শরীরে বহন করে নিয়ে এসেছে অনেকে। পরে নিজে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মশার মাধ্যমে তা আশেপাশের আরো লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলছে।
চিকনগুনিয়ার আক্রান্ত কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির ছাত্রলীগের সভাপতি মইন উদ্দীন জানান, তিনি বিশেষ কাজে ঢাকা গিয়েছিলেন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি এক পরিচিত জনের বাসায় উঠেছিলেন। ওই পরিচিত জন ছিলেন চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত। তার সাথে এক কক্ষে থেকে কক্সবাজারে চলে আসার তিন দিনের মাথায় চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হন মইন উদ্দীন।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) শাহীন আবদুর রহমান বলেন, চিকনগুনিয়া থেকে রক্ষা পেতে সবচেয়ে বেশি দরকার সচেতনতা। চিকনগুনিয়া বাহক সব ধরণের উপসর্গ এড়িয়ে চলতে হবে। সব মিলে কথা হলো মশার কামড় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা।’
কক্সবাজারের সিভিল সাজর্ন বলেন, চিকনগুনিয়া নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ অত্যন্ত সজাগ রয়েছে। আজকেও (গতকাল) কক্সবাজারের সফররত ত্রাণ ও দুর্যোগ সচিবের সাথে বৈঠক করেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তাঁর পরামর্শ মতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করার কাজ চলছে। কাল (আজ) জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সংশ্লিষ্ট নিয়ে বিশেষ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।’
তিনি বলেন, বৈঠকে চিকনগুনিয়া রোধে মশা নিরোধে পৌরসভার মেয়রসহ বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরাথ থাকবেন। তাদের সবাইকে মশা নিরোধে কার্যকর সিদ্ধান্ত হবে।’
চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ: ১. ভাইরাস শরীরে প্রবেশের দুই থেকে চার দিনের মধ্যে এর উপসর্গ দেখা দেয়। ২. প্রথমদিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। ৩. কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ৪. প্রায়ই তা একশ’ চার বা পাঁচ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উঠে যায়। ৫. মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, শরীর ব্যথা, ক্লান্তি, হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা, আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা হয়। ৬. জ্বর চলে যাওয়ার পর শরীরে লাল হয়ে ওঠে। ৭. শরীরে ঠান্ডা অনুভূতি। ৮. বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া। ৯. প্রায় এক সপ্তাহ অসুস্থতা থেকে যায়। ১০. অনেক সময় ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। ১১. সাধারণত ৭২-৯৭% রোগীর ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা দেয়। ১২. জ্বর ভালো হলেও অনেকদিন ধরে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিরোধের উপায়: চিকিৎসা বলছেন, চিকনগুনিয়া রোগটি ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও বেশ পীড়াদায়ক। কারণ জ্বর কমে গেলেও শরীর ব্যথা, দুর্বলতা ইত্যাদি দীর্ঘসময় ধরে থেকে যায়। আর এই রোগের বাহক হচ্ছে মশা। চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস ছড়ানো মশা দিনের বেলা কামড়ায়। তাই দিনের বেলা ঘুমালে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। এছাড়া মশা যাতে জন্মাতে না পারে সেজন্য ঘরদোর ও চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে।
বাসার ভেতরে ও বাইরে পড়ে থাকা বালতি, ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত যানবাহন, নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত চৌবাচ্চা, পরিত্যক্ত বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্লাস্টিক বা মাটির পাত্র, ফ্রিজ বা এয়ারকুলারের নিচে এবং বাড়ির ছাদ বা মেঝের নিচু স্থানে তিন দিনের অতিরিক্ত জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। তাই পরিত্যক্ত জিনিস জমতে দেবেন না এবং চারপাশ পরিষ্কার রাখুন। সম্ভব হলে জানালা এবং দরজায় মশা প্রতিরোধক নেট লাগান, যাতে ঘরে মশা প্রবেশ না করতে পারে। প্রয়োজনে শরীরের অনাবৃত স্থানে মশা নিবারক ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে (মুখমন্ডল ছাড়া)। চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হলে ভয়ের কিছু নেই। সময়মতো সুচিকিৎসায় চিকুনগুনিয়া ভালো হয়।
সিবিএন
পাঠকের মতামত