[caption id="attachment_10653" align="alignleft" width="400"] এই কিছুদিন আগেও ৯ বছরের জাহিদের কাজ ছিল সকালে স্কুলে যাওয়া, দুপুরে ঘরে ফিরে গরম ভাত খেয়েই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে চলে যাওয়া। তারপর সৈকতে ছাতার নিচে, আরাম কেদারায় বিশ্রামরতদের কাছে গিয়ে মিনতির স্বরে বলা, ‘ভাইয়া, একটা গান শোনাই?’[/caption]
অনলাইন ডেস্ক :
অবশ্য আপু/ভাইয়াদের অনুমতি মেলার আগেই সে গাইতে শুরু করে, ‘মধু হই হই আরে বিষ হাওয়াইলা’, ‘ওরে সাম্পান ওয়ালা’সহ আঞ্চলিক ভাষার এমন অনেক গান। শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ খুশি হয়ে তাকে ৫/১০ টাকা দিতেন। কেউ কেউ আবার গান শোনা শেষে বলতেন, ‘যা ভাগ’।
জাহিদ মন খারাপ না করে অন্য শ্রোতাদের খোঁজে যেত তখন। রাত হলে সারা বিকাল-সন্ধ্যায় বকশিশ পাওয়া টাকাগুলো গুনে নিয়ে বাড়ির পথ ধরতো। সেই টাকা দিয়ে পরদিন সকালে জাহিদের মা চাল-ডাল কিনে এনে রান্না করে তিন ছেলে আর এক মেয়ের সামনে দিতেন। তাই খেয়ে জাহিদ চলে যেত স্কুলে। আর বড় ভাই শহীদ চলে যেত সৈকতে কাজের খোঁজে। এভাবেই চলছিল জাহিদদের জীবন।
মাস সাতেক আগে একদিন জাহিদের গান শুনে ইমরান হোসাইন নামের এক পর্যটক তা ভিডিও করে নেন। সেই ভিডিও ছাড়া হয় ইউটিউবে। ব্যস, আর যায় কোথায়। রাতারাতি তারকা বনে যায় জাহিদ। ফেসবুক-ইউটিউবে শুরু হয় তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস। জাহিদ ও তার গান দিয়ে নির্মিত হয় একটি মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও।
জাহিদের ভাষায়, ‘ইন্টারনেটে ভিডো (ভিডিও) দেখার পরে সবাই এখন আমার গান শুনতে চায়। আমার সঙ্গে ছবি তোলে, কথা বলে, আমার মাথায় হাত বুলায় দেয়। সবাই আমারে অনেক আদর করে। আমি মডেলিংও করছি। টিভিতেও আমাকে দেখা যায়।’
ইউটিউবের কল্যাণে জাহিদের জীবন বদলে গেছে। আগে খালি গলায় গান গাইলেও এখন সে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গায়। গানের প্রশিক্ষণও নেয়। এখন তাকে গান শোনাতে এর কাছে, ওর কাছে ধরনা দিতে হয় না। বরং জাহিদ এখন গান শোনানোর ডাক পায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বড় বড় হোটেলে। তবে টাকার বিনিময়ে নয়, পেটে ভাতে! অনেক রাত অবধি তার গান শুনে আয়োজকরা তাকে পেট ভরে ভালো খাবার খাইয়ে বিদায় দেন। জাহিদ পেট ভরে খেলে যে, তার বাড়ির লোকেদের পেট খালি থাকে! এটুকু ভাবছে কি কেউ?
জাহিদ এখন যেমন কক্সবাজারের বিলাসবহুল হোটেল সায়মন বিচ রিসোর্টে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অন্য শিল্পীদের সঙ্গে গান গায়। এজন্য সে কোনও সম্মানী পায় না। যদিও আগে জানা গেছে, এই গাওয়ার বিপরীতে মাসে পাঁচ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হয় জাহিদের পরিবারকে। তবে জাহিদের বর্তমান ভাষ্য তা বলে না।
জাহিদ বলে, ‘হোটেলের লোকরা (কর্তৃপক্ষ) গান গাইলে কোনও টাকা দেয় না। গান শুনে খুশি হয়ে দুই একজন বকশিশ দেয়। এটুকুই।’ এতে তার দিনে গড়ে আয় হয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য জাহিদ ডাক পেলেও সেখানে গিয়ে তার বিশেষ কোনও লাভ হয় না। সবাই তাকে পেট ভরে ভালো খাবার খাইয়ে বিদায় জানায়। তবে গান শুনে কেউ কেউ যে তাকে বকশিশ দেয় তা জানাতেও ভুল করে না জাহিদ।
জাহিদকে নিয়ে প্রকাশিত প্রথম ভিডিওটি-
এরই মধ্যে জাহিদ একটি মুঠোফোনের বিজ্ঞাপনও করেছে। তার গাওয়া সেই জনপ্রিয় গান ‘মধু হই হই আরে বিষ হাওয়াইলা’ দিয়েই তৈরি হয়েছে বিজ্ঞাপনটি। বিজ্ঞাপনে গান শুরুর আগে জাহিদকে বলতে শোনা যায়, ‘ভাইয়া একটা গান শোনাই?’- যা জাহিদ বলত সব সময়। জাহিদ বলে, ওই মডেলিং করে ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। বিজ্ঞাপনে জাহিদকে যেভাবে উজ্জ্বল উপস্থাপন করা হয়েছে, বাস্তবে এখন তার অবস্থা ততোটাই করুণ।
৩০ সেপ্টেম্বর রাতে সায়মন বিচ হোটেলে তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল এই প্রতিবেদকের, তখন তার গায়ে ছিল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি। চেহারা ছিল ম্লান, চোখে ক্লান্তির ছাপ। কারণ, অতটুকুন শিশু প্রতিদিন টানা তিন-চার ঘণ্টা গাইতে হচ্ছে ‘বুড়ো’ অতিথিদের মনে আনন্দ জোগাতে!
জাহিদ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলের আঞ্চলিক গানে পারদর্শী হলেও সে সব ধরনের গান গাইতে পারে বলে জানালো। বললো, ‘আমি এখন গান শিখছি।’ কাদের কাছে শিখছ জানতে চাইলে সে বলে, ‘হোটেলে যারা গান গায় ওদের কাছে সুযোগ পাইলে শিখি।’
বিজ্ঞাপনচিত্রে জাহিদ-
জাহিদের বয়স যখন ৬ বছর তখন তার বাবা তাদের তিন ভাই ও এক বোনকে ফেলে চলে যায়। তারপর থেকে জাহিদরা তার বাবাকে আর খুঁজে পায়নি। জাহিদের বড় ভাই শহীদ সায়মন বিচ রিসোর্টের নিজস্ব সৈকতে ছাতা-চেয়ার বসানো, সরানোর কাজ করে। দুই ভাইয়ের যা আয় হয় তাই দিয়ে চলছে তাদের ৫ জনের সংসার। তারা তার মাকে কোনও কাজ করতে দিতে চায় না। এতো কষ্টের মাঝেও কিন্তু জাহিদ পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছে। সে কলাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র।
তার ইচ্ছে, যত কষ্টই হোক কিংবা ক্লান্তি ভর করুক শরীরে- গানটা সে গেয়ে যাবে সঙ্গে চালাবে পড়াশোনাটাও।
কারণ, তার আবিষ্কারক সেই পর্যটক ইমরান হোসাইন তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, পড়াশোনা করে অনেক বড় শিল্পী হওয়ার। সেই স্বপ্নের ঢেউ ধরেই চলমান সন্ধ্যাগুলো ডুব দিয়ে পার করছে ছোট্ট জাহিদ।
জাহিদকে আষ্কিার করার সেই গল্পটি-