অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্যের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে কক্সবাজারে। একের পর এক অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনায় বেশিরভাগই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। মুক্তিপণ দিতে না পারায় অনেকের খোঁজ মেলেনি। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত মূলহোতা পর্যায়ের কাউকে আটক বা গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, কক্সবাজারে এসব ঘটনায় জড়িত আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) অন্যতম নেতা হাফিজুর রহমান ওরফে ছলে উদ্দিন। এ যুবক বর্তমানে আরসা প্রধান আতাউল্লাহর পরেই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছলের গ্রুপে অপহরণ বাণিজ্যে জড়িত ১০ থেকে ১৫ জন। কক্সবাজারের গহীন পাহাড়ে ছলের আস্তানাও রয়েছে।
মিয়ানমার থেকে দেশে আসা রোহিঙ্গাদের তালিকা থাকলেও সরকারিভাবে ছলের কোনো নামের তালিকা পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ছলে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা নয়। প্রতিবারই অপরাধ করে তিনি আবার মিয়ানমারে আত্মগোপন করেন।
সম্প্রতি তাকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালালেও সে অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা জাগো নিউজকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে অভিনব সব কৌশলে কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। এ অপহরণ-বাণিজ্যে কারা জড়িত তাদের শনাক্তে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা গেছে, এ অপহরণ বাণিজ্যে সক্রিয় অন্তত ১০টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। অপহরণের পর টেকনাফের পাহাড়-জঙ্গলের আস্তানায় নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে তারা।
টেকনাফের বাহারছাড়া, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নে অপহরণ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। একের পর এক ঘটনা ঘটলেও কারা অপহরণে জড়িত তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে অপহরণকারীরা। অপহরণের পর মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। ফেরত আসা ব্যক্তিরা প্রাণনাশের ভয়ে অপহরণকারীদের সম্পর্কে কিছু বলছেন না।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আরসা নেতা হাফিজুর রহমান ওরফে ছলে উদ্দিন বর্তমানে আরসার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বাবার নাম মো. শফি। মাতা লতি বানু বেগম। মিয়ানমার থেকে এদেশে প্রবেশ করলেও ছলে বা তার পরিবার রোহিঙ্গা তালিকাভুক্ত না। দেশে থাকা রোহিঙ্গাদের তালিকায় কাগজে-কলমে নাম না থাকায় অপহরণ-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ নির্বিঘ্নে করে আসছেন ছলে উদ্দিন। ছলের গ্রুপের সদস্যরা নানা অপরাধে জড়িত।
বিশেষত সম্প্রতি কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অপহরণের ঘটনার প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন এই ছলে। আরসা নেতা আতাউল্লাহর নির্দেশে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহাড়ে অবস্থা করে ছলে বাহিনী। সেখানেই অপহৃতদের জিম্মি করে রাখা হয়। পরে অর্থের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হয়। নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে এই ছলে ও তার দলবল মিয়ানমারে আশ্রয় নেয়।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে থেকে ভারত, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে মানবপাচারে জড়িত এই ছলে বাহিনী। বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকলেও ছলের নাম রোহিঙ্গা তালিকায় না থাকায় তাকে আইনের আনা সম্ভব হচ্ছে না।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে আইজিপি
কক্সবাজারে গভীর সমুদ্র থেকে আসা ট্রলার থেকে ১০ জনের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পাওয়ার কথা জানিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, তারা ওই ঘটনার মূলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। গত বুধবার বিকেলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন আইজিপি। এর আগের দিন মঙ্গলবার কক্সবাজার সফরে যান আইজিপি। বুধবার সকালে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন।
গত ২৩ এপ্রিল কক্সবাজার শহরের উপকূলবর্তী এলাকায় একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এদের মধ্যে ছয়জনের পরিচয় শনাক্তের পর মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, হাফিজুর রহমান ওরফে ছলে উদ্দিন আরসা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য। সে (ছলে) আরসা নেতা আতাউল্লার নির্দেশে অপহরণ, ডাকাতি, ও মাদক চোরাচালানে জড়িত। তার ভয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লোকজন ভীত। বিভিন্ন সময় এই ছলে উদ্দিন ক্যাম্পে বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তাকে ধরতে অভিযান চালানো হলেও তাতে সফল হওয়া যায়নি।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ছলে বাহিনীসহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এ এলাকায় বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি ডাকাতি ও অপহরণসহ বিভিন্ন ঘটনায় আমরা অপরাধী শনাক্তে কাজ করছি। এরই মধ্যে অপহৃত দুজনকে ৩৫ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে উদ্ধার এবং একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ডাকাত চক্রগুলোর তৎপরতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারী-শিশুসহ অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার খবর এসেছে। অপহরণকারী চক্রের মূলহোতা ও সদস্যদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সুত্র: জাগো নিউজ
পাঠকের মতামত