খাসজমি স্থায়ীভাবে বন্দোবস্তির দাবিতে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়ক অবরোধ করেন জলবায়ু উদ্বাস্তু লোকজন। আজ সকালেছবি: প্রথম আলো
উচ্ছেদ বন্ধ করা ও খাসজমিতে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দেওয়ার দাবিতে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়ক প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাসকারী কয়েক হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু নারী-পুরুষ। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে সড়ক অবরোধ শুরু হয়। অবরোধের কারণে কক্সবাজার বিমানবন্দরে যাতায়াতের সড়কটি বন্ধ হয়ে পড়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েন মানুষ।
‘উচ্ছেদ আমরা মানি না/বাপের ভিটা ছাড়ব না’, ‘আর নয় উচ্ছেদ/দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তি চাই’, ‘উচ্ছেদের ভয় নয়/বাঁচার অধিকার চাই’—এ ধরনের লেখা–সংবলিত ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন অবরোধকারীরা। অবরোধের এক পর্যায়ে তাঁরা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করেন। পরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি পাঠানোর মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শেষ হয়।
বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা জানান, তাঁরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বসতভিটা হারিয়ে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়াসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে এসে কক্সবাজার শহরে বাস করছেন। কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের খাসজমিতে বসতভিটা হারানো প্রায় ৭০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তুর বসবাস। ছয় হাজার একর জমিতে ১০ হাজারের বেশি পাকা ও আধা পাকা ঘর করে তাঁরা রয়েছেন। ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে গড়ে ওঠা এসব বসতিকে ঘিরে মসজিদ-মাদ্রাসা যেমন হয়েছে, তেমনি গড়ে উঠেছে প্রায় ৮০০ শুঁটকিমহাল। অথচ এখন জলবায়ু উদ্বাস্তুদের স্থায়ী পুনর্বাসন না করে সরকারি এই খাসজমি থেকে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল, পূর্ব কুতুবদিয়াপাড়া সমাজ কমিটির সভাপতি নুরুদ্দিন খান, মধ্যম কুতুবদিয়াপাড়া সমাজ কমিটির সভাপতি আবুল বশর, ফদনারডেইল জামে মসজিদের খতিব মাওলানা জাহেদুর রহমান, ব্যবসায়ী ছাবের আহমদ, আইনজীবী জাহেদুল ইসলাম, শিক্ষক এজাবত উল্লাহ প্রমুখ। সমাবেশে এ ছাড়া সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন পৌরসভার সাবেক মেয়র সরওয়ার কামাল, সাবেক কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা ছিদ্দিকী ও জিসান উদ্দিন, জেলা যুবদলের সভাপতি ছৈয়দ আহমদ উজ্জল, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফাহিমুর রহমান। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পাঠানো স্মারকলিপিতে ৬৮২ একর জায়গা ১ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাসকারী জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ১ নম্বর ওয়ার্ডের পুরো জায়গাটি সরকারি খাসজমি। এলাকাটিতে বিপুলসংখ্যক জলবায়ু উদ্বাস্তুর বাস। তাঁদের জন্য খুরুশকুলের ১৩৭টি পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। আড়াই বছর আগে ২০টি ভবনে ৬০০ পরিবারের ঠাঁই হয়েছে। আরও ৮৫টি ভবন তৈরি হয়েছে, সেখানে আরও ২ হাজার ৭২০ পরিবার থাকতে পারবে।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আকতার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে ১২ হাজার পরিবারের ৬০ থেকে ৭০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু সমুদ্র উপকূলের এই এলাকায় বসবাস করে আসছেন। জীবন–জীবিকার জন্য উপকূলের নাজিরারটেক এলাকায় গড়ে তোলা হয় দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকিমহাল। ৪৫ হাজারের বেশি জলবায়ু উদ্বাস্তু নারী-পুরুষ শুঁটকিমহালে শ্রমিকের কাজ করেন। কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ ও বিমানবাহিনীর ঘাঁটি নির্মাণের জন্য প্রায় ৭০০ একর খাসজমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ১০ হাজার ঘরবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাবেক এই কাউন্সিলর আরও বলেন, এই ওয়ার্ডে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে ফ্ল্যাটবাড়ি পাচ্ছে না, এমন পরিবারের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। এসব পরিবারের সদস্য রয়েছেন ৩০ হাজারের মতো। তাঁরা এখন যেখানে রয়েছেন, সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চান।
পূর্ব কুতুবদিয়াপাড়া সমাজ কমিটির সভাপতি নুরুদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সমাজে ৫০০ পরিবারের অন্তত তিন হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তুর বসবাস। সবাই কুতুবদিয়া উপজেলার বাসিন্দা। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি-সম্পদ হারিয়ে তাঁরা শহরের এই বালুচরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারে মিয়ানমারের সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মাথা গোঁজার ঠাঁই ও ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হয়েছে, ১২ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের জন্য কেন কিছু করা যাবে না। আমরা উচ্ছেদ নয়, সরকারি এই খাসজমিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ চাই। এটা আমাদের নাগরিক অধিকার।
পাঠকের মতামত