সারোয়ার সুমন ::
ওয়াসিম ও ফরিদ দু’জনের বাড়ি একই এলাকায়। তাঁরা কক্সবাজারে বসবাসও করতেন একই বাসায়। দু’জনের কর্মস্থলও একই স্থানে। কক্সবাজার জেলা ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার তাঁরা।
২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঘুষের ৬৫ লাখ টাকাসহ ওয়াসিমকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই দিনই অভিযান চালিয়ে আরেক সার্ভেয়ার ফেরদৌসের বাসা থেকে ২৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় পরে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা হলে একে একে ১৩ জন গ্রেপ্তার হন। এঁদের কেউ সার্ভেয়ার, কেউ তহশিলদার, কেউ দালাল- এককথায় চুনোপুঁটি। অথচ এ ঘটনায় উদ্ধার করা হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর থাকা রোয়েদাদ বইসহ সাত বস্তা বিভিন্ন আলামত। নিয়মানুযায়ী রোয়েদাদ বই থাকার কথা তৎকালীন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা রেজাউল করিম কিংবা তাঁর সুপারভাইজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসারের কাছে। কিন্তু ঊর্ধ্বতন এই দুই কর্মকর্তার কারও টিকিটিও স্পর্শ করেনি দুদক।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও নাম এসেছে ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তাদের। ঊর্ধ্বতনরা ঘুষের ভাগ পেয়েছেন বলে উঠে এসেছে তদন্তেও। তারপরও ভূমি অধিগ্রহণের কোনো ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি কোনো রাঘববোয়াল।
ভূমি অধিগ্রহণের নামে কক্সবাজারের তিন মেগা প্রকল্পে সংঘটিত হয়েছে ৭৮ কোটি টাকার দুর্নীতি। এ দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৪০ জনকে চার্জশিটভুক্ত আসামি, ১৫ জনের বিরুদ্ধে নতুন মামলা এবং ৯৬ জনের বিরুদ্ধে সম্পদ অনুসন্ধানের নোটিশ করার অনুমতি চেয়ে দুদকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন গিয়েছিল গত বছরের ৩০ জুন। এখন যাঁরা ঘুষ ও দুর্নীতির টাকাসহ হাতেনাতে ধরা পড়ছেন, তাঁদের অনেকের নাম ছিল সেই তদন্ত প্রতিবেদনে।
কিন্তু ৬২০ পৃষ্ঠার সেই তিন তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা পড়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন ৭৮ কোটি টাকা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রধান হোতারা।
তিন তদন্ত প্রতিবেদনে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাঁদের বেশিরভাগই রাঘববোয়াল। এঁদের মধ্যে পৌর মেয়রসহ রাজনীতিবিদ রয়েছেন সাতজন, চেয়ারম্যান দু’জন, জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ২০ জন, পুলিশ সুপারসহ পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা চারজন, সার্ভেয়ার ২৩ জন, কানুনগো আছেন সাতজন।
এ ছাড়া তহশিলদার ছয়জন, সাব-রেজিস্ট্রার দু’জন, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ছয়জন ও ব্যাংকের ম্যানেজার রয়েছেন তিনজন। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছিলেন চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন।
সম্প্রতি ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদেরও কয়েকজন ছিলেন সেই তালিকায়।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত শুক্রবার ২৩ লাখ টাকাসহ আটক হন সার্ভেয়ার আতিকুর রহমান। এর আগে কক্সবাজার শহরের একটি বাসা থেকে জমি অধিগ্রহণের ঘুষ হিসেবে নেওয়া প্রায় এক কোটি টাকাসহ ওয়াসিম নামের এক সার্ভেয়ারকে আটক করে র্যাব-১৫। অনিয়মের অভিযোগে আরেক সার্ভেয়ার শাহিনুর আলমকে বরখাস্তও করে জেলা প্রশাসন। এঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল অনেক আগেই।
দুদক শরিফ উদ্দিনের তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে তা পুনর্তদন্ত করছে।
দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন ও উপসহকারী পরিচালক নসরুল্লাহকে পুনর্তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে রিয়াজ উদ্দিন এতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তারপরও কমিশন তাঁদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে। পুনর্তদন্তের এই সময়ও পেরিয়েছে ছয় মাস। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি।
পুনর্তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিনের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। তবে আরেক তদন্ত কর্মকর্তা উপসহকারী পরিচালক নসরুল্লাহ বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি বিস্তারিত কিছু জানি না। তবে এখনও পুনর্তদন্তের প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। আরও সময় লাগবে আমাদের।’
প্রসঙ্গত, কক্সবাজারে তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৫টি মেগা প্রকল্পসহ কয়েকটি প্রকল্পের জন্য প্রায় ২০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করছে সরকার। এটি ঘিরে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
২৯ কোটি টাকার দুর্নীতিতে যাঁদের নাম :এসপিএম প্রকল্পে ২৯ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে এক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অভিযুক্ত হিসেবে এখানে যাঁদের নাম এসেছে তাঁরা হলেন- সাবেক সার্ভেয়ার সাঈদ হোসাইন, সাবেক সার্ভেয়ার কবির আহমদ, সাবেক কানুনগো মো. আব্দুল খালেক, সাবেক অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল করিম, নুর মোহাম্মদ, দিল মোহাম্মদ, ছৈয়দ আহাম্মদ, মোহাম্মদ আবুদ শুক্কুর, আবদুল মজিদ, মো. রিদুয়ান, নুরুন্নাহার, সার্ভেয়ার ওয়াসিম খান, সার্ভেয়ার ফরিদ উদ্দিন, সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা রেজাউল করিম, কানুনগো মুহাম্মদ শাহনওয়াজ কুতুবী, সাবেক সার্ভেয়ার মো. আসাদুজ্জামান, সাবেক সার্ভেয়ার আবদুল কাইয়ুম, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম সরোয়ার কামাল, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার, ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফ, চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন খোকন, হোসাইন মোহাম্মদ আল নোমান শরীফ, এহসানুল করিম, জালাল উদ্দিন, নুরুল ইসলাম বাহাদুর, ছৈয়দ আকবর, আমান উল্লাহ, আনোয়ারা বেগম, আরিফ মোহাম্মদ ইফতেখার রশিদ, প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত, এম দিদারুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইব্রাহীম, মোহাম্মদ হোছাইন, সাঈদ হোসাইন, সেলিম উল্লাহ, সাবেক অফিস সহকারী অর্জুন কুমার দত্ত, সাবেক সার্ভেয়ার রাসেল মাহমুদ মজুমদার, সাবেক সার্ভেয়ার মিশুক চাকমা
৩৬ কোটি টাকার দুর্নীতিতে নাম যাঁদের :কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ৩৬ কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে অভিযুক্ত করা হয় সার্ভেয়ার মো. ফরিদ উদ্দিন, কক্সবাজার পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার, সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এইচ এম মাহফুজুর রহমান, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ নূর হোসেন, সাবেক কানুনগো বাচ্চু মনি চাকমা, সাবেক ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা মিজবাহ উদ্দিন, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাশেদুল ইসলাম, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজিম উদ্দিন, কানুনগো বসন্ত কুমার চাকমা, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদ, আবুল হোছাইন, মোহাম্মদ ছৈয়দ নুর, রেকর্ডকিপার জসীম উদ্দীন, সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ জাহেদ হোছাইন, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ শাহরিয়ার মুক্তার, সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) মোহাম্মদ ইসহাক, পৌর সচিব রাছেল চৌধুরী, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা শামীম হুসাইন ও আতাউর রহমান, কানুনগো নুরুল ইসলাম, সার্ভেয়ার সাইফুল ইসলাম, সার্ভেয়ার আই এম আশরাফুজ্জামান, মিজানুর রহমান, ফারহানা আক্তার, মমতাজুল ইসলাম, মফিজুর রহমান, মাহবুবুর রহমান, খোরশেদা বেগম, মোস্তাক আহমদ, মোছাম্মৎ মাহমুদা খাতুন, রেজাউল করিম, মোজাফফর আলী, সালা উদ্দিন, হাসান মেহেদী রহমান, মিজানুর রহমান, জাবেদ মো. কায়সার নোবেল, সেলিম উল্লাহ, সাবেক সার্ভেয়ার মিশুক চাকমা, সাবেক সার্ভেয়ার ফেরদৌস খান, পিকলু চৌধুরী ও পরিমল চন্দ্র দাস, সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবদুল মোমিন, নুরুল হুদা কাজল, সাবেক কানুনগো হাবিব উল্লাহকে।
২২ কোটি টাকার দুর্নীতিতে যাঁদের নাম :ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে পিবিআই প্রকল্প ঘিরেও হয়েছে দুর্নীতি। ২২ কোটি টাকার এ দুর্নীতিতে যাঁদের নাম এসেছে দুদকের প্রতিবেদনে, তাঁরা হলেন- সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খান, ফরিদ উদ্দিন, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক এম সাকের আহমেদ, সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার, সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এইচ এম মাহফুজুর রহমান, সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবু হাসনাত মো. শহিদুল হক, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ-আল-মামুন, সাবেক অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা দেবতোষ চক্রবর্তী, সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার মাজেদা বেগম, সাব-রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক কানুনগো আবুল কালাম আজাদ, সাবেক সার্ভেয়ার আনোয়ার কবির আনন্দ ও ছৌজি চাকমা, সার্ভেয়ার শাহীনুর আলম, সাবেক অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাজাহান আলি, সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা অজিত দেব, সাবেক সার্ভেয়ার আব্দুল মতিন, আবু তাহের ও মিলন কান্তি চাকমা, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বিজয় কুমার সিংহ, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা শামীম হুসাইন, সার্ভেয়ার জিয়াউর রহমান ও সাইফুল ইসলাম, কানুনগো নুরুল ইসলাম, ভূমি অধিগ্রহণ অতিরিক্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক উপপরিচালক শ্রাবন্তী রায়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আমিন আল পারভেজ, পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম, মার্কেন্টাইল ব্যাংক শাখা প্রধান মেহেরাব হোসেন খান, প্রিন্সিপাল অফিসার রেজাউল হক, অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার তারেক মাহমুদ, মোহাম্মদ ইদ্রিস, নুরুল হক, বেলায়েত হোসেন, জিন্নাত রেহেনা, শাওরিন জাহান চৌধুরী, নেজামুল হক, নাছির উদ্দিন, মিজানুর রহমান, টিপু সুলতান, এস কে এম শামীমুর রহমান, গোলাম মওলা, অধ্যাপক মো. আজিজুর রহমান, অ্যাডভোকেট হোছাইন আহমদ আনচারী, সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মামুন, মনির আহমদ, নুরুল আবছার, কামাল উদ্দিন, রাশেদুল মজিদ, ফরহাদ ইকবাল, কাউন্সিলর ওমর ছিদ্দিক লালু, সাহাব উদ্দিন, শাহানা রহমান, আবু মোর্শেদ মো. শাহজাহান, শাহজাহান মনির, নুরুল হাকিম, সোহেল, সালা উদ্দিন, এমদাদুল হক।
পাঠকের মতামত