উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। এমনিতেই গরমে অতিষ্ঠ জেলাবাসী তার উপর তীব্র লোডশেডিং। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। তীব্র গরমের মধ্যে যন্ত্রণায় স’ানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদেরও হাঁসফাঁস অবস’া। কক্সবাজার জেলার আট উপজেলার চিত্র প্রায় অভিন্ন। জেলা শহরে প্রতিদিন সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে না। উপজেলাগুলোতে এ সময় প্রায় ১৮ থেকে ২০ ঘন্টা। দিন ও রাতের অধিকাংশ সময়ই কক্সবাজারে লোডশেডিং বিরাজ করায় পর্যটন শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক সপ্তাহ ধরে অতিরিক্ত লোডশেডিং এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্বির কারণে পর্যটন শহর কক্সবাজারে বসবাসকারী প্রায় ২৩ লাখ মানুষের অবস’া নাকাল। পাশাপাশি অচল হয়ে পড়ছে হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস, চিংড়ি উৎপাদনের হ্যাচারি, বরফকলসহ কয়েক হাজার ক্ষুদ্র শিল্প, পোলট্রি খামার ও প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া গ্রামের অবস’া অনেক বেশি শোচনীয়।
রাতের বেলায় শহরের অধিকাংশ এলাকায় ডুবে থাকছে অন্ধকারে। এর ফলে চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাচ্ছে। অনেকেই লোডশেডিং থেকে বাঁচতে জেনারেটর ব্যবহার করছে। কিন’ জেনারেটরের বিরক্তিকর শব্দের কারণে কক্সবাজার শহরবাসী এবং পর্যটকদের মাঝে অস্বস্তিকর পরিসি’তি সৃষ্টি করছে। গ্রামে দৈনিক বিদ্যুৎ থাকছে মাত্র ৪/৫ ঘন্টা বা তারও কম।
লোডশেডিং এর মাত্রা এত বেশি যে ভুক্তভোগিরা বলছেন বিদ্যুৎ থাকে না মাঝে মধ্যে আসে। পিডিবির আওতাধীন এলাকায় দিন ও রাতে অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না আর পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহকদের অবস’া খুবই করুণ। এতে কর্তৃপক্ষের সাপ কথা উপর থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে না। আমরা কোথ থেকে দেব। তবে মানুষ সেটা মানতে নারাজ তাদের দাবী অনৈতিক সুবিধা নিয়ে কর্তৃপক্ষ কিছু এলাকাকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে।
কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরস্কুল ইউনিয়নের গ্রাম ডাক্তার বাসিন্দা লিটন দে বলেন, একদিকে প্রচন্ড গরম অন্যদিকে তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের অবস’া খুবই কাহিল হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ থাকে না মাঝে মধ্যে আসে। ভোর ৫টার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেছে। এসেছে বিকাল ৩টার দিকে। তাও সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট থাকার পর আবার গেছে এসেছে সন্ধ্যা ৬ টার দিকে। এরপরে রাত ৮ টার দিকে গেছে রাতে ২ টার সময়ও আসে না। এর মধ্যে গরমের কারণে বাসায় ঘুমাতে না পেরে আমরা ছোট বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি। এখন বাচ্চারা সবাই অসুস’ হয়ে পড়েছে।
কক্সবাজার ভ্রমণে আসা ঢাকার দম্পতি সুজন ও সুপ্রিয়া বলেন, কক্সবাজারে বিদ্যুতের এ অবস’া জানতে পারলে আসতাম না। হোটেলে জেনেরেটারের ব্যবস’া থাকলেও বাইরে বেরুলে খুব খারাপ অবস’া। এর উপর বিভিন্ন স’ানে জেনেরেটরের বিকট শব্দ। মনটাই খারাপ হয়ে যায়।
সিরাজুল্লাহ নামের এক খামারি বলেন বিদ্যুৎ না থাকার ফলে আমার খামারের মুরগি সব মারা যাওয়ার অবস’া হয়ে পড়েছে। আমার ১০০০ মুরগির খামারে এবার কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকার লোকসান হতে পারে।
৫৪ হ্যাচারি বন্ধের উপক্রম
লোডশেডিংয়ের কারণে কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে স’াপিত ৫৪টি চিংড়ি পোনা উৎপাদনের হ্যাচারি বন্ধের উপক্রম হয়েছে। উখিয়ার সোনারপাড়ার বলাকা হ্যাচারির মালিক নজিবুল ইসলাম জানান, জেনারেটর চালিয়ে পোনা সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। জেনারেটর বন্ধ হলে মুহূর্তে লাখ লাখ পোনা মারা যায়।
উখিয়ার সোনার পাড়ায় অবসি’ত সৌদিয়া হ্যাচারির ম্যানেজার আবুল কালাম জানান, ভয়াবহ লোডশেডিং আমাদের ব্যাপক লোকসানে ফেলবে। কি জানি ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবো কিনা।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, প্রতিদিন ৫৪টি হ্যাচারিতে কমপক্ষে ১৫ হাজার লিটারের বেশি জ্বালানি খরচ করা হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে দৈনিক ১১ লাখ টাকারও বেশি। এসব হ্যাচারিতে উৎপাদিত প্রায় এক হাজার কোটি পোনা দিয়েই খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কক্সবাজারসহ সারা দেশের দেড় লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়।
চার শতাধিক হোটেল ব্যবসায় ধস
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার জানান, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সৈকতের চার শতাধিক হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস অন্ধকারে থাকে। জেনারেটরে এসব হোটেলে সারা রাত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এতে দুর্ভোগের শিকার হয়ে পর্যটকরা ফিরে যাচ্ছেন। ফলে হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস ব্যবসায় ধস নেমেছে। যেখানে প্রতিদিন চার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন সেখানে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে এক মেগাওয়াটেরও কম।
তিনি জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে পর্যটকরা হোটেলে থাকতে অনীহা প্রকাশ করেন। এ কারণে চলতি মাসে পর্যটকের আগমনও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এতে সরকারও মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
৫০ বরফ মিল বন্ধের পথে
বরফ মালিকরা জানান, কক্সবাজার সদরসহ জেলাব্যাপী ৫০টি বরফ মিল রয়েছে। এ সব বরফ মিল থেকে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার বরফ তৈরি হয়। কিন’ ভয়াবহ লোডশেডিং এর কারণে এসব বরফ মিল ও শ্রমিকরা অলস সময় পার করছে। বরফ তৈরি না হওয়ায় সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পিক সময়ে বরফ সরবরাহ করতে না পারায় বরফ মালিকরা গুনছে লোকসান। অন্যদিকে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় বরফ না পাওয়ায় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার মাছ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট কক্সবাজারের বরফ মিল ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
দৈনিক ঘাটতি ৪০ মেগাওয়াট
কক্সবাজার নাগরিক কমিটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা জানান, অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে এই জেলার আটটি উপজেলায় লাখ লাখ গ্রাহক চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এখানকার পর্যটন, হ্যাচারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসছে। পর্যটন শহর বিবেচনা করে এ জেলার জন্য অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা উচিত।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার পাওয়ার গ্রিড কোম্পানিতে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার পিডিবি এবং পল্লী বিদ্যুৎ মিলিয়ে বিদ্যুৎ এর চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ ৮০ মেগাওয়াট। সেখানে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ মেগাওয়াট পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তারও কম।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার নূর মো. আজম মজুমদার বলেন, আমাদের দৈনিক চাহিদা থাকে ৫০ মেগাওয়াটের বেশি। সেখানে আমরা পাই ২৫ থেকে ৩০ এর মত। তাই লোডশেডিং একটু বেড়েছে। তবে ৩ দিন ধরে কিছু বিদ্যুৎ লাইন উন্নতির জন্য সংস্কার কাজ চলছে। সেটা গ্রাহকদের প্রচারণার মাধ্যামে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
একইভাবে কক্সবাজার পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের চাহিদার বিপরীতে প্রাপ্তি অনেক কম, তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। তাছাড়া মাঝে মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়ে বিভিন্ন স’ানে লাইনের সমস্যা হয়, তারের সমস্যা হয়, ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে যায়- সব মিলিয়ে এসব মেরামত করতেই প্রচুর সময়ের ব্যাপার, তাই অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেও লোডশেডিং হচ্ছে।