কক্সবাজারের চকরিয়ায় অভিযানে গিয়ে ডাকাতির হামলায় এক সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। নিহত সেনা কর্মকর্তার নাম লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন (২৩)।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে উপজেলার অন্তর্গত ডুলহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন তার সাবেক রুমমেট আসিফ সরকার। পোস্টে তিনি লেখেন, ও আসলেই আমার ছোট ভাইয়ের মত ছিল। রুমে এসে কখনো কি খাব জিজ্ঞেস করত, এটা সেটা বানাত, গিটার নিয়ে গান করতে করতে হঠাৎ থেমে যেত যখন দেখত আমি নামাজে দাড়িয়েছি। খুব মনোযোগি শ্রোতা ছিল ছেলেটা, চোখ দুটো কথা বলত ওর। আজ সেই চোখে কোন দৃষ্টি নেই।
পাঠকদের জন্য আসিফ সরকারের পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো :
কক্সবাজারে সন্ত্রাসীদের হামলায় সেনা কর্মকর্তা নিহত
ছেলেটা আমার রুমমেট ছিল চকরিয়া আর্মি ক্যাম্পে। আমার শখের বিড়াল চার্লি আর সিম্বা ওরই দেয়া উপহার। সারাদিন রাত অফিসের কাজে ইউনিটের জুনিয়র অফিসার হিসেবে ও খুবই ব্যস্ত থাকত, কিন্তু সেই লাগামছাড়া ক্লান্তিতেও ওর মুখের হাসিটা কখনো মলিন হতে দেখিনাই। অফিস যাওয়ার টাইমে প্রায় দিন ও আমার বাইকটা নিয়ে অফিস চলে যেত, আমিও ভান করতাম আমি আজকে অফিসে বাইক নিবনা।
ও আসলেই আমার ছোট ভাইয়ের মত ছিল। রুমে এসে কখনো কি খাব জিজ্ঞেস করত, এটা সেটা বানাত, গিটার নিয়ে গান করতে করতে হঠাৎ থেমে যেত যখন দেখত আমি নামাজে দাড়িয়েছি। খুব মনোযোগি শ্রোতা ছিল ছেলেটা, চোখ দুটো কথা বলত ওর। আজ সেই চোখে কোন দৃষ্টি নেই। অপারেশনে রাতের অন্ধকারে গলায় গুলি করার পর দুইজন স'ন্ত্রাসী সেই চোখটার ভিতরেও ছুরি গেথে দিয়েছে। দেহখনা নিথর, কথা বলা চোখগুলো আজ শুধু নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছে।
একটা বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ টা অফিসার মারা যাওয়ার সময় আমি ছিলাম না, সেই সময় প্রত্যেকটা অফিসারের বুকের মাঝে সেই অসহায়তা কি রকম ঝড় তুলেছিল তা আমি কল্পনা করতে পারিনা। তবে এবার সেই রক্তের দাগ যেন এই ইউনিফর্মে না লাগে আল্লাহর কাছে আমি সর্বান্তকরণে সেই দুয়া করি। আর যদি অনেক কিছুর ভিড়ে এটাও কোন স্রোতে হারিয়ে যায় তবেও আমরা যেন জানি, উপরে যিনি আছেন একদিন তার সামনে সব প্রকাশ হবেই। তিনি ছাড় দেন, তবে ছেড়ে দেন না।
ছেলেটা কি অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়েছে মৃত্যুর সময় তা আমার কল্পনায় শুধু ভেসে ভেসে আসে। একটু শ্বাসের জন্য হাসফাস, বুটের আওয়াজে হয়ত চাপা পড়ে যাচ্ছিল ওর কাতরানোর আওয়াজ। যে কষ্টটা আমার ভাইটা মৃত্যুর সময় পেয়েছে, আল্লাহ যেন ওকে জান্নাতুল ফেরদৌস দিয়ে ওর সেই যন্ত্রণা লাঘব করেন।
এদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) জানায়, সোমবার রাত আনুমানিক ৩টার দিকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চকরিয়া উপজেলার অন্তর্গত ডুলহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে ডাকাতির খবর পেয়ে চকরিয়া আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল দ্রুততার সাথে ঘটনাস্থলে যায়।
পরে রাত ৪টার দিকে মাইজপাড়া গ্রামে অভিযান পরিচালনা করার সময় ৭-৮ সদস্যের একটি ডাকাত দল সেনা টহল দলের উপস্থিতি টের পেয়ে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার সময় লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন (২৩) ডাকাত দলের কয়েকজনকে তাড়া করেন।
এ সময় ডাকাত দলের সদস্যরা লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জনের ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করলে গুরুতর আহত হয় এবং এতে তার প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তাৎক্ষণিকভাবে লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জনকে উদ্ধার করে মালুমঘাট মেমোরিয়াল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, ঘটনাস্থল থেকে ৩ জন ডাকাতকে আটকসহ ১টি দেশিয় তৈরি বন্দুক, ৬ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও ডাকাত সন্দেহে আরও ৩ জনকে আটক করা হয়।
আইএসপিআর আরও জানায়, দেশমাতৃকার সেবায় এই তরুণ সেনা কর্মকর্তার আত্মত্যাগ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে এবং সেই সাথে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সকল সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন টাঙ্গাইল জেলার একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী এই তরুণ সেনা কর্মকর্তা পাবনা ক্যাডেট কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ৮২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হতে ২০২২ সালের ৮ জুন আর্মি সার্ভিস কোরে (এএসসি) কমিশন লাভ করেন।