ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার::
একের পর এক দখল আর বন্দোবস্তে হারিয়ে যাচ্ছে কক্সবাজারের পাহাড়-বনভূমি। রক্ষা পাচ্ছে না ‘প্রতিবেশ সংকটাপন্ন’ বনাঞ্চলও। পরিবেশবিদরা বলছেন, যে গতিতে বন দখল চলছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে কক্সবাজারে হয়তো কোনো বনভূমি থাকবে না। কেননা, এরই মধ্য এখানকার মোট বনভূমির চার ভাগের এক ভাগ দখল হয়ে গেছে। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, দখলদার ৪৪ হাজারের বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
জেলার চকরিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি মৌজায় ৩৬১ দশমিক ৩৫ একর জায়গা ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল চিংড়ি চাষের জন্য বিভিন্ন লোককে বন্দোবস্ত দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। সহকারী সচিব মো. জসিম উদ্দিন পাটওয়ারী স্বাক্ষরিত বন্দোবস্ত অনুমোদনপত্রে বলা হয়, ‘কক্সবাজার জেলা চিংড়িসম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ ও প্রস্তাব অনুযায়ী এই জমি ১০ বছর মেয়াদের জন্য একরপ্রতি বার্ষিক দুই হাজার টাকা ইজারামূল্যে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।’
দুই মাস পর জেলা প্রশাসন ওই বন্দোবস্ত প্রস্তাব যাচাই-বাচাইয়ে বন বিভাগকে একটি চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের চকরিয়া সুন্দরবন রেঞ্জ কর্মকর্তা একটি প্রতিবেদন দেন জেলা প্রশাসককে। এতে বলা হয়, ‘প্রাথমিক তদন্তে ৩৬১ দশমিক ৩৫ একরের মধ্যে ৫০ একর জায়গা কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন গেজেটভুক্ত বনভূমি। এ ছাড়া উপকূলীয় বন বিভাগের কী পরিমাণ জমি ইজারার মধ্যে রয়েছে, তা যাচাই চলছে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, বন বিভাগের ওই প্রতিবেদনের পরও ইজারা বাতিল না করে উল্টো বন্দোবস্ত পাওয়া লোকজনকে জায়গা দলিল করে দেয় জেলা প্রশাসন। তবে এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাহিদ ইকবাল সমকালকে বলেন, ‘বন বিভাগের প্রতিবেদনের বিষয়টি আমার জানা নেই। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরই ইজারা গ্রহীতাদের দলিল করে দেওয়া হয়েছে।’
এ ছাড়া ১৯৭৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ এপ্রিল এবং ১৯৮২ সালের ১৪ জানুয়ারি তিন দফায় বন বিভাগের গেজেটভুক্ত ৭ হাজার একর জমি চিংড়ি চাষের জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে সরকার। পরে মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সেই জমি বিভিন্ন লোককে বন্দোবস্ত দেয় মৎস্য বিভাগ।
কক্সবাজার উপকূলীয় বন বিভাগের আইনজীবী ফরিদুল আলম বলেন, ‘চিংড়ি চাষের জন্য বন্দোবস্ত দেওয়া সব জমিই বনভূমি। চিংড়ি চাষ করতে গিয়ে নির্বিচারে প্যারাবন (বাইন ও কেউড়া গাছ) কাটা হয়েছে। অথচ গাছগুলো দুর্যোগের সময় উপকূলের মানুষকে ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা করত।’
চিংড়িমহাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে ১৯৯২ সালের ৩০ মার্চ একটি পরিপত্র জারি করে ভূমি মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, ‘চিংড়ি চাষোপযোগী অনুকূল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চিংড়ি চাষের এলাকাগুলো চিংড়িমহাল হিসেবে ঘোষণা করা হবে। চিংড়িমহালের বন্দোবস্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই মৎস্যজীবী, মৎস্য ব্যবসায়ী অথবা মৎস্য প্রক্রিয়াকারী হতে হবে।’ ওই পরিপত্রের পর জেলায় ১৩ হাজার ৯৯৫ একর জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধেকসংখ্যক ইজারা গ্রহীতা চিংড়ি চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাদের কেউ রাজনীতিবিদ, কেউ গৃহবধূ, কেউ আইনজীবী এবং কেউ সাংবাদিক বা ব্যবসায়ী।
বন বিভাগের আইনজীবী ফরিদুল আলমের অভিযোগ, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও জেলা প্রশাসন থেকে চিংড়ি চাষের জন্য জায়গা ইজারা দেওয়া হচ্ছে। আর বন বিভাগ এর বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিচ্ছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাহিদ ইকবাল অবশ্য বলছেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশে চিংড়ি চাষের জন্য জমি ইজারা স্থগিত রয়েছে।’
দখল হয়ে গেছে সংরক্ষিত বন
কক্সবাজার শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে শুকনাছড়ি এলাকায় বড় বড় পাহাড়। মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশের এসব পাহাড়কে ব্রিটিশ আমলে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৯ সালে সরকার এগুলোকে ‘প্রতিবেশ সংকটাপন্ন’ বনভূমি ঘোষণা করে। কিন্তু ২০২১ সালে এই এলাকার ৭০০ একর বনভূমি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বানাতে এক লাখ টাকা প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ দেওয়া হয় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। উচ্চ আদালতের নির্দেশে আপাতত স্থগিত রয়েছে ওই বরাদ্দ কার্যক্রম। বন বিভাগ বলছে, লিখিত আপত্তি জানানোর পরও বন বিভাগের জমি এভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা। একাডেমির রেক্টর (সচিব) ড. মো. ওমর ফারুককে একাধিকবার ফোন করে এবং মেসেজ পাঠিয়েও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
একই প্রক্রিয়ায় ২০২২ সালের ৪ জুলাই কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পাশে খুনিয়াপালং মৌজায় ২৫ একর সংরক্ষিত বন দেওয়া হয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে)। সেখানে তৈরি হবে আবাসিক প্রশিক্ষণ একাডেমি। জায়গাটি বরাদ্দের সময়ও আপত্তি জানিয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় বন বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়, ‘একাডেমি স্থাপনে সেখানে পাহাড়ের পাশাপাশি কাটা পড়বে প্রায় ৩০ হাজার গাছ। বনটি মহাবিপদাপন্ন এশিয়ান হাতির আবাসভূমি। একাডেমি স্থাপনে বনের হরিণ, শূকর, বানরসহ অনেক প্রজাতির পশুপাখি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলম বলেন, ‘বাফুফেকে দেওয়া জমিটি সংরক্ষিত বন। আপত্তি দেওয়ার পরও সেটি তাদের দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় যখন সিদ্ধান্ত নেয় তখন আমাদের আর কিছু করার থাকে না।’
২০২২ সালে কক্সবাজার বিভাগীয় বন কার্যালয় থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারে ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ হাজার ২৮৮ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, শহীদ এটিএম জাফর আলম মাল্টিডিসিপ্লিন একাডেমি ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়; ফেরত দেওয়ার শর্তে ২০২১ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়কে বনের ১২ হাজার ৩৪১ দশমিক ৮১ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে পাহাড় ও গাছ কেটে তৈরি করা হচ্ছে স্থাপনা; চাষ হচ্ছে চিংড়ি।
বনভূমি অবৈধভাবে দখলকারীদের উচ্ছেদে ব্যবস্থা নিতে গত বছর কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে তালিকাসহ একটি চিঠি পাঠায় স্থানীয় বন বিভাগ। ওই তালিকা অনুযায়ী, সেখানে বনভূমি দখলদার ৪৩ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও ৬৯৬ প্রতিষ্ঠান। কক্সবাজার উত্তর বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন সরকার জানান, মাঠ পর্যায়ের কর্মী দিয়ে দখলদারের ওই তালিকা করে জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়েছে। কারণ, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বন বিভাগের নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই তালিকা পাঠানোর এক বছর পেরিয়ে গেলেও বনভূমি দখলকারী উচ্ছেদে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বন ধ্বংসে এগিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান
কক্সবাজারে পাহাড় ও বনভূমি দখল নিয়ে একটি গবেষণা করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস)। ২০২২ সালে প্রকাশিত ‘কক্সবাজারে বনভূমির বিপন্নতা’ শীর্ষক তাদের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজারে বন ধ্বংসে এগিয়ে সরকারি সংস্থাগুলো। বনভূমি ইজারা নিতে তারাই আবেদন করছে বেশি।
বেলা ও ইয়েসের ওই গবেষণায় দেখা যায়, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য যে পরিমাণ বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় আড়াই গুণ বনভূমি বরাদ্দ নিয়েছে খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্প ও সরকারি সংস্থার কার্যালয় করার নামে কক্সবাজারকে বনভূমিশূন্য করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এখানকার মোট বনভূমির চার ভাগের এক ভাগ দখল হয়ে গেছে। কীভাবে একটি জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা ধ্বংস হয়, তার বড় উদাহরণ কক্সবাজার। অথচ পাহাড়-বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষাই হওয়ার কথা ছিল এখানকার মূল বিষয়।’
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা সমকালকে বলেন, ‘পাহাড় একটি প্রাকৃতিক স্থাপনা। এগুলো দুর্যোগ থেকে মানুষকে বাঁচায়। অথচ আমরা উন্নয়ন করব বলে এগুলো ধ্বংস করে ফেলছি।’ গবেষণার মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিত করে সমন্বিত উদ্যোগে কক্সবাজারের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করার কথা বলেন তিনি।
বন বিভাগের কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলম বলেন, ‘কক্সবাজারে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বনের বালু ও মাটি ব্যবহার হচ্ছে। গাছ তো এখন তেমন নেই। তারপরও পাহাড় কাটা হচ্ছে। এগুলো মোকাবিলা করেই কাজ করতে হচ্ছে বন কর্মীদের।’ তাঁর মতে, বনভূমি রক্ষা করে কক্সবাজারে কোথায় কী হবে, সে বিষয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান দরকার।
‘এখানে পরিবেশ-প্রতিবেশ বলতে কিছু থাকবে না’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক মো. কামাল হোসাইন ২০২২ সালে তাঁর ‘বাংলাদেশের কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বনাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের আগমনের প্রভাব’ শীষক গবেষণায় বলেন, ‘কক্সবাজারের বনে ১৭৬ বংশের ২৬৮ প্রজাতির গাছ রয়েছে। বনভূমি ধ্বংসের কারণে এসব গাছ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। সমকালকে তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারে বন ধ্বংসের যে প্রক্রিয়া চলছে, তা অব্যাহত থাকলে এখানে পরিবেশ-প্রতিবেশ বলতে কিছু থাকবে না।’
জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি-২০০১ এর অনুচ্ছেদ ১৭ অনুযায়ী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ঘোষিত বনাঞ্চল বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত থাকবে এবং বনভূমির সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাহিদ ইকবাল বলেন, ‘মানুষও পরিবেশের অংশ। এই পরিবেশে মানুষকেও টিকে থাকতে হবে। তা ছাড়া উন্নয়নকে অস্বীকার করা যায় না। পরিবেশ ধ্বংস হবে– এ কথা বলে মেগা প্রকল্প থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই।’ তাঁর মতে, পরিবেশের ক্ষতি যতটা সম্ভব কমিয়ে উন্নয়ন করলে সেই উন্নয়নকে স্বাগত জানানো উচিত।
যা বললেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী
কক্সবাজারে পাহাড়-বন দখলের বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘দেশে বেদখল বনভূমির তিন ভাগের দুই ভাগই কক্সবাজারে। দখলদারদের উচ্ছেদে বহুবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বনভূমি উদ্ধারে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। উচ্ছেদ অভিযানে গেলে শিল্পপতি-প্রভাবশালীরা আদালতে রিট করে স্থিতাবস্থা নিচ্ছে। তাই বনভূমি দখলকারীর তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। বনের একচুল জমিও বেদখলে যেতে দেব না।’
তিনি বলেন, ‘গত তিন বছরে দখল হওয়া ২৪ হাজার ৩২২ একর বনভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা জায়গায় বনায়ন হয়েছে। দখল বনভূমি পুনরুদ্ধারের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। সুত্র; সমকাল