॥ ক্যাপ্টেন (অব:) আবদুস ছোবহান : ॥
মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাছে দেশের শত্রুরা টিকে থাকতে পারেনি। বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করেছে এ দেশের মানুষকে, কিন্তু ঠেকাতে পারেনি। বাঙালিরা লক্ষ লক্ষ প্রাণ দিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে, সম্পদ দিয়েছে। বিনিময়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা, বাংলার পতাকা, বাংলার সম্মান ইত্যাদি। দীর্ঘ নয় মাস বাঙালির সাথে হাড়ভাঙ্গা যুদ্ধ করার পর পাকিস্তানী বাহিনী যখন দেখলো, তাদের বিজয়ের কোন সম্ভাবনা নেই, পরাজয় তাদের নিশ্চিত। তখনই তারা যেদিকে পারে পালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পালিয়ে যাবার আগেই সমস্ত এলাকা মুক্তিযোদ্ধারা এক এক করে দখল করে নেয় এবং অনেক আলবদর-রাজাকার ও পাকিস্তানী সৈন্যদের গ্রেফতার করে।
১২ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমরা কক্সবাজার শহর দখল করার উদ্দেশ্য চারটি বাসে করে পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প হতে সকাল ১০টায় যাত্রা শুরু করি। রেডক্রস কর্মকর্তা প্রদত্ত সাদা জীপ, কপিল উদ্দিন চৌধুরী (রতœাপালং) ও জনাব জিয়াউদ্দিন চৌধুরী (রতœাপালং) আমাদেরকে চারটি বাস জোগাড় করে দেন। আমাদের যাত্রা পথে কোন কোন স্থানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তার সহযোগিরা উৎপেতে থাকতে পারে এবং অতর্কিত আক্রমণ করতে পারে আশংকা করে অস্ত্রের নল গাড়ীর বাইরের দিকে রেখে সামনে আগাতে থাকি। সেই দিন ছিল মরিচ্যা বাজারের সাপ্তাহিক হাটবার। লোকে লোকারণ্য, আমরা যখন কোটবাজার ও মরিচ্যা বাজারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন রাস্তার দু-পার্শ্বে হাজার হাজার লোক দন্ডায়মান হয়ে দুই হাত উপরে তুলে আমাদেরকে স্বাগত জানায়। তাদের মুখে ছিল জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি গগণ বিদারী শ্লোগান। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আমরা বাধাহীন ভাবে লিংক রোড পর্যন্ত পৌছি। শুনলাম লিংক রোডের দক্ষিণে পাহাড়ে পাকবাহিনী অবস্থান করেছে। রেকী করে দেখলাম তাদের কোন অস্তিত্ব নেই। অতঃপর হাশেমিয়া মাদরাসা পর্যন্ত যাবার পর আমার সহযোদ্ধাদেরকে ৪টি গ্রুপে বিভক্ত করি। যাতে কক্সবাজার এলাকা সহজে ঘেরাও করা সম্ভব হয়।
গ্রুপ গুলোর অবস্থান :
১ম ঃ (আমি নিজে) সোজা রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত।
২য় ঃ হাশেমিয়া মাদ্রাসার পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে দক্ষিণে কিছ ুদুরে গিয়ে পশ্চিম দিকের রাডার ষ্টেশন পর্যন্ত।
৩য় ঃ হাশেমিয়া মাদরাসা থেকে কিছু দুরপশ্চিমে গিয়ে দক্ষিণে কক্সবাজার রাডার ষ্টেশন পর্যন্ত।
৪র্থ ঃ হাশেমিয়া মাদ্রাসা থেকে সোজা সুজি উত্তর দিকে কিছু দুর গিয়ে বাঁকখালীর পাশ দিয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। এ ছাড়া সকল গ্রুপকে নির্দেশ দিলাম রাডার ষ্টেশনে মিলিত হবার জন্য। এবারে তাগিদ অনুভব করি। কারণ শুনেছিলাম সেখানে পাকবাহিনীর অফিস ছিল এবং সেখানেই তারা আমার দেশের অসহায় মানুষকে ধরে নিয়ে আসতো। হত্যা করতো নির্যাতন চালাতো। মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করতো। সার্কিট হাউজে পৌছার পর আমার মনপ্রাণ দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরা শিহরিত হয়ে উঠলো। অঝোর ধারায় নেমে এলো দু-চোখ বেয়ে অশ্রু, শুধু আমার কেন, আমার সাথের এমন কেউ ছিলো না যারা কষ্ট পায়নি। কি নির্মম পাক-হায়েনাদের আচরণ। এখানে ওখানে ছিটিয়ে আছে মানুষের কংকাল, গাড়, মাথা ইত্যাদি। মনে হচ্ছে ঐ অবস্থায়ও তাঁরা বাঁচতে চাচ্ছে, স্বাধীনতা চাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমাদের কাছে তাঁদের করুন আর্তনাদ, আমরা তো বাঁচতে পারলাম না। আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত বাঁচান, আতœীয়-স্বজনদেরকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করুন। এদেশ স্বাধীন করুন। এদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানীদের তাড়িয়ে দিয়ে আমাদের হত্যার প্রতিশোধ নিন। ক্ষণকাল নিশ্চুপ থেকে মনের একান্ত গহীণস্থল থেকে কথাগুলো অনুভব করলাম। কষ্ট হয়েছে প্রচুর। পাশাপাশি ঘৃণার সঞ্চার হয়েছে ঐ সব পাষন্ডদের উপর।
ক্রমান্বয়ে শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে করতে দেখলাম জনশূন্য ঘরবাড়ী, অফিস আদালতের সব দালানই ক্ষত-বিক্ষত। এখানে-ওখানে বুলেটের আঘাতের চিহ্ন। হানাদার বাহিনী পরাজয়ের গ্লানি মুছনের জন্য পাগলের মত উৎপাত করছে। ,ইতোমধ্যে আমরা রাডার ষ্টেশনে পৌছি এবং পূর্ব পরিকল্পনা মতে সকল গ্রুপকে একত্রিত অবস্থায় পাই। অতঃপর আমি আনুষ্ঠানিক ভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলাম। পতাকা উত্তোলনের সময় আমার মনের অবস্থা কি হয়েছে তা লিখে বুঝানোর ভাষা আমার জানা নেই। শুধু বুঝেছিলাম শরীরের প্রত্যেকটি লোম শিহরে উঠছিলো। আমার সহযোদ্ধারা সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গাইতে লাগলো। সাথে সাথে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে গেলো নয় মাস এর ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা। মনে হলো আমি যেন আকাশের চাঁদটা পেড়ে এনে দেশের মানুষকে উপহার দিতে পেরেছি। রাডার ষ্টেশন এমন একটি জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে যা সমুদ্র পথ আকাশ পথ, স্থল-পথ প্রতিটি দিক থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। আর তাই এই ষ্টেশনে পতাকা উড়ালাম যাতে মিত্র বাহিনী আমাদের পতাকা দেখে এবং কক্সবাজরের কোন ক্ষতি সাধন না করে। এছাড়া আরো বুঝা যাবে, কক্সবাজার এখন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। শত্রুবাহিনীরাও বুঝতে পারবে অন্তঃত এই কক্সবাজারে তাদের আর স্থান হবে না। সেখান থেকে আমরা পাবলিক লাইব্রেরীতেও পতাকা উত্তোলন করি এবং সেখানে এসে দেখি আরো হৃদয় বিদারক দৃশ্য! শুধু রক্ত আর রক্ত, জমাট বাধা রক্ত। অথচ আজকের পৃথিবীতে একফোঁটা রক্তের কত যে মুল্য। রক্তের অভাবে মারা পড়ছে হাজার হাজার অসুস্থ মানুষ। কিন্তু সেই সময় আবর্জনার মতো সাগর জলের জোয়ারের ন্যায় মানুষের তাজা রক্ত পদদলিত হয়েছে অন্য মানুষের চলার পথে। শত শত কুকুর, কাক-পক্ষী পান করেছে এসব। একটু ফিরে তাকানোর মত কেহই ছিলো না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই রক্তের বন্যা থেকে পরিচয় মেলেনি কার রক্ত। তবে নিঃসন্দেহে এই রক্ত ছিলো মুক্তিকামী মুক্তমনের অধিকারী স্বাধীনচেতা বাঙালির। যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। এসব ভেবে মন কাঁদলেও দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়নি। কারণ দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। আমি একটি মাইক নিয়ে শহরময় আমাদের আগমন ও পতাকা উত্তোলনের খবর প্রচার করার নির্দেশ করলে সহযোগিরা তাৎক্ষনিক ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
মাইকে প্রচার করা হলো ঃ
১। মুক্তি বাহিনী কক্সবাজার দখল করে শত্রুমুক্ত করেছে।
২। রাডার ষ্টেশন ও পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে।
৩। দেশ প্রেমিক জনগণের ভয় নেই।
৪। শত্রুবাহিনী এবং স্বাধীনতা বিরোধীরা পাবলিক লাইব্রেরীতে এসে কক্সবাজার ও বান্দরবান এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক আবদুস সোবহানের নিকট আত্মসমর্পণ কর।
এই সংবাদ শুনার সাথে সাথে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত হাজার হাজার জনতা পাবলিক লাইব্রেরীর মাঠে উপস্থিত হয়। এ যেন মানুষেরই সমুদ্র। তাদের আহাজারীতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হলো। স্বজন হারানোর ব্যাথা প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। আমি কাকে রেখে কার কথা শুনবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাদেরকে সান্ত¡না দেবার ভাষাও আমার জানা নেই। শুধু স্বাধীন হওয়ার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিলাম।
অতঃপর নূর হোটেলের সামনে একটি লম্বা কাঠ দিয়ে আমাকে জীপের উপর দিয়ে দেয়া হলো জনতার উদ্দেশ্য কিছু বলার জন্য। তাৎক্ষনিকভাবে কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবু যতটুকু পেরেছি তাদেরকে সান্ত¡না দিতে চেষ্টা করেছি। আমার বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ ঃ-
মুক্তি পাগল ভাই ও বন্ধুরা। আপনারা আমার সংগ্রামী অভিনন্দন এবং কক্সবাজার জেলার বিজয় বার্তা গ্রহণ করুন। নয় মাস-এর সমস্ত দুঃখ বেদনা আজকের এই বিজয় দিয়ে মুছে ফেলুন। আপনারা যাঁদেরকে হারিয়েছেন তাদের জন্য মন খারাপ করবেন না। বরং তাদের মৃত্যু নিয়ে গর্ববোধ করুন। মনে রাখবেন তাঁরা স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছেন। তাঁরা চির অমর, এই সেই কক্সবাজার যেখানে প্রখ্যাত ছাত্রনেতা সুভাসকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে পাষন্ডরা। এই সেই কক্সবাজার যেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ফরহাদকে মুমুর্ষ অবস্থায় তার দেহ কুকুর বিড়ালকে দিয়ে ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে। এই সেই কক্সবাজার যেখানে এডভোকেট পীযুষ বাবুর শ্রদ্ধেয় পিতা-এডভোকেট জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরীকে ঘর থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদেরই প্রাণের বিনিময়ে, তাজা রক্তের বিনিময়ে, পাকবাহিনী দখলমুক্ত কক্সবাজার আজকে আমাদের কক্সবাজার, বাঙালিদের কক্সবাজার। সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে আমি এই বীর শহীদ ও দেশপ্রেমিক মানুষের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং মহান আল্লাহর কাছে তাঁদের জন্য দোয়া ও মাগফেরাত প্রার্থনা করছি।
আপনাদের কাছে আমার ছোট্ট অনুরোধ রেখে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি ঃ- এখন থেকে পাক-বাহিনীর সদস্য, রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ স্বাধীনতা বিরোধী যাদেরকে পাবেন আমার কাছে ধরে নিয়ে আসবেন। তবে আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কক্সবাজারের শাসন কার্য আমাদের নির্দেশেই চলবে।
উক্ত বক্তব্য শেষ করে আমি সহযোদ্ধাদের নিয়ে আমার নির্দিষ্ট অবস্থানে ফিরে যাই। আমার আনন্দ, আমার আকাঙ্খা, আমার স্বপ্ন, আমার সম্মান-সবকিছুই আমি ফিরে পেয়েছি, বাংলার পতাকা উড়ানোর ভেতর দিয়ে। সংগ্রামী জীবনের চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?
লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধের অধিনায়ক, কক্সবাজার-বান্দরবান।উৎস, দৈনিক কক্সবাজার
পাঠকের মতামত