স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কক্সবাজারে। মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। বন্যায় দেউলিয়া হয়েছেন অনেক চিংড়ি ঘের মালিক। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সড়ক, গ্রামীণ রাস্তা ও কালভার্টগুলোর। পানিতে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ও হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি।
প্রশাসন বলছে, পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সময় লাগবে এক সপ্তাহ। আর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য।
কক্সবাজারের ৯ উপজেলার ৬০ ইউনিয়নে ক্ষতির চিহ্ন রেখে গেছে এবারের বন্যা। ৬ দিন পানিবন্দি থাকে ৫ লাখ মানুষ। পাহাড় ধস ও পানির ঢলে মৃত্যু হয় ২০ জনের। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চকরিয়া উপজেলা। এ উপজেলায় ১১ জন, পেকুয়ায় ৬ জন, উখিয়াতে দুইজন ও রামুতে এক জনের মৃত্যু হয়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানিয়েছেন, বন্যায় সড়ক বিভাগের ৫৯ কিলোমিটার সড়ক এবং এলজিইডির ৮০ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা ও ৪৭ ব্রিজ/কালভার্ট বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাস্তা পানিতে ডুবে আছে। পানি নেমে গেলে আর্থিক মূল্য জানা যাবে।
জেলায় ১৫ হাজার ৬৩৮ হেক্টর ফসলি জমি, ১ হাজার ৭৫২টি পুকুর/ দীঘি/ খামার, ১ হাজার ৮৩২টি মৎস্য ঘের, ২৬২ মেট্রিক টন ফিন ফিশ, ৭০০ মেট্রিক টন চিংড়ি, ৯.৯৫ মেট্রিক টন পোনা ও ১৭৯টি জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠা অসম্ভব।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘৫ কানি জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। কিন্তু বন্যার পানিতে সব শেষ। এখন ঘরবাড়ি মেরামত করব নাকি চাষের জমি ঠিক করব- কিছুই বুঝতে পারছি না। আর টাকা কার কাছে পাব সেটাও জানি না। কারণ এলাকার সবাই তো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত।’
বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় বসতঘরে হাটু পানি। ছবি: সময় সংবাদ
লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, ‘একেবারেই পথে বসে গেলাম। বন্যা সব শেষ করে দিয়েছে।’
বদরখালী এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ হায়দার বলেন, বন্যার পানিতে সব চিংড়ি ভেসে গেছে। পথে বসে গেলাম। এই ক্ষতি কবে কাটিয়ে উঠব, কে বা সাহায্য সহযোগিতা করবে!
দক্ষিণ কাকারা এলাকার রাশেদুল ইসলাম বলেন, মাতামুহুরীর নদী সংলগ্ন ৩ কিলোমিটার সড়ক ও গাইড ওয়াল বন্যার পানিতে ভেঙে তছনছ। যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। মানুষজনের দুর্ভোগের শেষ নেই।
কৈয়ারবিল ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল আল মামুন বলেন, হাজার হাজার একর ধান খেত, সবজি খেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন এলাকার মানুষ চাষের জমি কীভাবে ঠিক করবে আর কোথায় বীজ পাবে এই দুশ্চিন্তায় রয়েছে।
বন্যার তাণ্ডবে এখনো দিশেহারা মানুষ। তাই দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, বন্যার পানি নেমে গেছে। এখন মানুষের দুর্ভোগ চরমে। ক্ষতিগুলো দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা প্রয়োজন।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের নানা ধরনের প্রকল্প রয়েছে। যা দ্রুত চালু করতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি অনেকগুলো এনজিও রয়েছে তারাও বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে।
কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম জানালেন, বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সাময়িক মানুষের কষ্ট হলেও দ্রুত এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সব ধরনের কার্যক্রম চালু হবে।
শুক্রবার বন্যা কবলিত চকরিয়া এলাকা পরিদর্শন করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, ভারি বৃষ্টিপাত ও মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাস্তাঘাট বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। এই অবস্থায় চকরিয়া উপজেলার জনগণের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ধরনের ব্যবস্থা নেবেন।
চকরিয়া উপজেলার বন্যা কবলিত ৭০ হাজার পরিবারের জন্য ভিজিএফ চাউল বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডবে চকরিয়া উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত সব সড়ক ও বেড়িবাঁধ সংস্কারে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আশ্বাস দেন।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, বন্যায় চকরিয়া উপজেলার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। এখনো পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। সকল দফতর থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ ক্ষয়ক্ষতি তথ্য সংগ্রহ করছেন। ভয়াবহ বন্যার পূর্ণাঙ্গ ক্ষতির পরিমাণ জানতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
বন্যার কারণে চকরিয়া উপজেলার ১৩ ইউনিয়ন ও পেকুয়া উপজেলার ৬ ইউনিয়ন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
পাঠকের মতামত