কক্সবাজার জেলার ২১ লাখ মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল ২৫০ শয্যার হাসপাতাল। প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে চিকিৎসা নিতে আসে অসংখ্য রোগী। তবে সরকারি এ হাসপাতালটিকে কেন্দ্র করে আশপাশে গড়ে উঠেছে কিছু ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বিভিন্ন সময় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে এসব ক্লিনিকের মনোনীত এক শ্রেণীর মানুষ। প্রান্তিক এলাকা থেকে আসা রোগীদের কাছ থেকে সুযোগসন্ধানী এসব মানুষ চিকিৎসার নামে হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, শহরের বাইরে থেকে কোনো রোগী এলে হাসপাতাল সড়ক থেকেই ফুসলিয়ে তাদের নিয়ে যায় নির্ধারিত ডাক্তারের চেম্বার বা ক্লিনিকে। ডাক্তার রোগীকে দেখে ৮০০-১০০০ টাকা ভিজিট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ ধরিয়ে দেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ৪-৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এখানেও সেই ডাক্তারের কমিশন মেলে। সপ্তাহ ও মাস ধরে ওষুধ খেয়েও কোনো উপকার হয় না রোগীর। এসব কর্মকাণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো দালাল ও প্রতারক থেকে সাবধান থাকার জন্য সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। তবুও প্রতারণার শিকার হচ্ছে রোগীরা। ফলে আরোগ্যের চেয়ে জটিল হচ্ছে রোগ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সুযোগসন্ধানী বলেন, ‘কক্সবাজারে অনেক ডাক্তার কমিশন দেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমরা হাসপাতাল এলাকায় থাকি। কোনো রোগী পেলে ওই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। বিনিময়ে কমিশন মিলে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার একমাত্র সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতাল। এর আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল। এসব হাসপাতালের মনোনীত প্রতিনিধিরা সরকারি হাসপাতালের কতিপয় চিকিৎসক, সেবিকা ও কর্মচারীর যোগসাজশে রোগী বাগিয়ে নেয়ার কাজটি করছে।
সম্প্রতি টেকনাফ উপজেলার শামলাপুর থেকে কক্সবাজার শহরে উন্নত চিকিৎসার জন্য আসেন আমির হোসেন ও তার এক আত্মীয়। তবে তাদের উন্নত চিকিৎসা দেয়ার কথা বলে কক্স ন্যাশনাল হাসপাতালের পাশের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান এক সুযোগসন্ধানী। পরে প্যাথলজি পরীক্ষার নামে তার কাছ থেকে ৩ হাজার ৪৫০ টাকা হাতিয়ে নেয়।
একই অভিযোগ মহেশখালীর হোয়ানক এলাকার নূর হোসেনের। তার স্ত্রীকে কম টাকায় অস্ত্রোপচার করে দেয়ার কথা বলে একটি অখ্যাত হাসপাতালে নিয়ে ৪৫ হাজার টাকা বিল করা হয়।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গিখালী থেকে আসা সাবের মিয়াও একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল সড়কে তিন নারী ও এক পুরুষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভালো হবে বলে নিয়ে যান কক্স ন্যাশনাল হাসপাতালে। সেখানে প্রথমে ১ হাজার টাকা নেন ডাক্তার। পরে পরীক্ষার ফি বলে নেন ৬ হাজার ১০০ টাকা। সবশেষ শরীরে বিভিন্ন সমস্যা আছে বলে ৪ হাজার টাকার ওষুধ ধরিয়ে দেন।’
উখিয়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা আমির হোসেন বলেন, ‘হাসপাতাল সড়কে টুপি পরা এক লোক আমাকে কক্স ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে যান। অপারেশন করতে হবে হবে বলে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে দিদার নামে আমার এক আত্মীয় উদ্ধার করেন। এর পর আল ফুয়াদ হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে আমার কোনো নেই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কক্সবাজার এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিতে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এদের আইনের আওতায় আনতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জোরালো ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।’
সুযোগসন্ধানী চক্রের বিষয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মং টিং ঞো বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেলার প্রধান হাসপাতাল হিসেবে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। ভিড় আর অব্যবস্থার মধ্যে সুযোগসন্ধানী চক্র অপতৎপরতা চালিয়ে যায়। হাসপাতালে কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা নির্ধারিত ইউনিফর্ম ব্যবহার করেন না বলে সাধারণ রোগীরা সুযোগসন্ধানী এবং কর্মচারীকে চিহ্নিত করতে পারেন না। কর্মচারী ভেবে নিয়মিত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। তবে সুযোগসন্ধানী হাসপাতালে আগের চেয়ে এখন অনেক কম।’
এ প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও রীতিমতো চিন্তিত। সুযোগসন্ধানীদের স্থানীয়রাই সবচেয়ে বেশি চেনেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
পাঠকের মতামত