টানা ছুটিতে এবার কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে এসেছেন লাখেরও বেশি পর্যটক। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও বাংলা নববর্ষের টানা ছুটিতে ঘুরতে এসেছেন তারা। ঈদের দিন কিছুটা কম থাকলেও শুক্রবার সকাল থেকে বাড়তে শুরু করে পর্যটকের সংখ্যা।
আজ রোববার এই সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এতে জমে উঠেছে কক্সবাজারে পর্যটককেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। তবে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমনে তাদের হোটেল, রিসোর্ট ও গেস্ট হাউজে জায়গা দিতে বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। সবগুলো হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউজ এবং কটেজের কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে যাওয়ায় অনেকে ভোগান্তি পড়েছেন। কেউ কেউ একাধিক হোটেল ঘুরে কক্ষ না পেয়ে ফিরে গেছেন।
অনেকে হোটেলে কক্ষ না পেয়ে সৈকতে রাত কাটাচ্ছেন। আবার অনেকেই মহেশখালীর ঐতিহ্যবাহী আদিনাথ মন্দির দেখতে গেছেন। কেউ কেউ মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় ঘুরেছেন। তবে ভেতরে ঢোকার অনুমতি না থাকায় সমুদ্র সৈকত থেকে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র দেখছেন তারা। এছাড়া সাবরাং ট্যুরিজম স্পট, শামরাপুর নানা রঙের সাম্পানের সৈকত, জাহাজপুরা শতবর্ষী গর্জন ট্যুরিজম স্পটে ঘুরেছেন পর্যটকরা।
কক্সবাজারে পর্যটকের রাতযাপনের জন্য হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউজ ও কটেজ আছে সাড়ে চারশতাধিক। এসবে দৈনিক ধারণক্ষমতা এক লাখ ২৮ হাজার। গত শুক্রবার, শনিবার ও আজ রোববার তিনদিনে পাঁচ লক্ষাধিক পর্যটক আসায় হোটেল-রিসোর্টে কক্ষ পাননি বেশিরভাগ। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।
কক্সবাজার হোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ সমকালকে বলেন, ঈদের দিন বিকেল পর্যন্ত হোটেল ও গেস্ট হাউজগুলোর ৯০ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়েছিল। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ কক্ষ ওইদিন রাতের মধ্যে বুকিং হয়ে যায়। ফলে শুক্রবার যারা এসেছেন; কক্ষ পাননি। এদিন অন্তত দেড় লাখের বেশি পর্যটক এসেছেন। একইভাবে শনিবার ও আজ আরও তিন লাখের বেশি পর্যটক আসেন। সব মিলিয়ে তিনদিনে পাঁচ লক্ষাধিক পর্যটক আসায় অনেকে হোটেলের কক্ষ পাননি।
হোটেল মালিক ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত বছর ঈদের টানা পাঁচ দিনের ছুটিতে সৈকতে চার লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটেছিল। হোটেল-রেস্তোরাঁসহ নানা খাতে তখন ব্যবসা হয়েছিল হাজার কোটি টাকার। এবারও চার লাখ পর্যটক সমাগমের আশা করেছিলেন তারা। কিন্তু তা ছাড়িয়ে গেছে। সৈকতের পাশাপাশি কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, টেকনাফ, রামু, চকরিয়া ও মহেশখালীর বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে দর্শনার্থীর ভিড় বেড়েছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঙাভাব ফিরেছে। আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পর্যটকের সমাগম থাকবে। সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে এবার অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে।
আজ বিকেলে সৈকতের সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে দেখা গেছে, প্রচুর পর্যটকের ঢল। সুগন্ধা থেকে কলাতলী পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সৈকতে হাজার হাজার পর্যটক। উত্তর দিকে সিগাল থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত দুই কিলোমিটারে ভিড় করেছেন আরও কয়েক হাজার পর্যটক। এর মধ্যে অনেকে সৈকতে গোসলে নেমেছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দে মেতেছেন অনেকে। সব মিলিয়ে সৈকতজুড়ে দেড় থেকে দুই লাখ পর্যটক দেখা গেছে।
কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল কবির পাশা পল্লব সমকালকে বলেন, ‘অতিরিক্ত গরমের কারণে ঈদের আগে পর্যটকশূন্য ছিল কক্সবাজার। ঈদের প্রথমদিনেও তেমন সমাগম ছিল না। কিন্তু ঈদের পরদিন শুক্রবার সকাল থেকে পর্যটন সমাগম দ্বিগুণ হয়ে যায়। অথচ এর আগের দিনই হোটেল-মোটেলের শতভাগ কক্ষ বুকিং হয়ে গিয়েছিল। কোনো হোটেলে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ পাইনি। যদি অভিযোগ পাই এবং ওই হোটেল আমাদের সমিতিভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে ব্যবস্থা নেবো।’
কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘রোজার মাসে অধিকাংশ হোটেল-রেস্তারাঁর সংস্কার কাজ হয়েছে, অনেকগুলো বন্ধ ছিল। তবে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। সবগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের কাছ থেকে খাবারের অতিরিক্ত মূল্য আদায় হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খাবার টেবিলে মূল্যতালিকা রাখা থাকে। কাজেই বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই।’
ইনানী সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটক হাবিব কামাল বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে এসে কোনো হোটেলে কক্ষ পাইনি। ভোগান্তিতে পড়েছি। যেখানে গেছি, সেখানেই বলেছে কক্ষ নেই। তাই রাতটা সৈকতেই কাটিয়ে দেব।’
কুমিল্লা থেকে সপরিবারে বেড়াতে আসা ব্যবসায়ী কায়সার হামিদ বলেন, ‘কক্সবাজারে যতবার এসেছি, ততবারই এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে। মন খারাপ থাকলে কিংবা লম্বা ছুটি পেলেই পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসি। এবার আব্বা-আম্মা, বড় ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এলাম।’
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ রিজিয়নের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আপেল মাহমুদ বলেন, ‘নিরাপত্তা এবং সেবা দিতে সৈকত ছাড়াও অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রে ট্যুরিস্ট পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যটকদের জন্য ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু করেছি আমরা। যে কোনো সমস্যায় পড়ে পর্যটকরা একটি বাটন চাপলেই আমাদের সেবা পাবেন।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ সমকালকে বলেন, পর্যটকের সেবা নিশ্চিতে জেলা প্রশাসন সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। হোটেলে-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় অতিরিক্ত টাকা আদায়, পর্যটকদের হয়রানি বন্ধসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমুদ্রসৈকত এবং আশপাশের বিনোদন কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত রয়েছে। ভ্রমণ শেষে পর্যটকরা নিরাপদে ঘরে ফিরুক এটাই আমাদের চাওয়া।’