
তাহজীবুল আনাম, কক্সবাজার::
কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলে পরিযায়ী পাখির বিচরণ আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে। খাবারের সন্ধানে খাল-বিল, নদী-জলাশয়ে এসে লাখো পাখি অসাধু শিকারির ফাঁদে পড়ে মারা যাচ্ছে। এছাড়া নদী, জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ, কলকারখানা, নগরায়ন এবং নির্বিচারে গাছ ও পাহাড় নিধনের ফলে পাখি তার আবাসস্থল হারাচ্ছে। যার কারণে দিনদিন বিলুপ্তির পথে পরিযায়ী পাখি।
এক সময় উপকূলে দলবেধে খাদ্য সংগ্রহ করতে দেখা যেতো হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। শীত মৌসুমের শুরুতে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, সাইবেরিয়া, মধ্য এশিয়া, রাশিয়া ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতো অতিথি পাখির দল। কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকাগুলোয় পরিযায়ী পাখির দেখা মিলতো সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি বাসা বাধতো প্যারাবন ও গ্রাম অঞ্চলের গাছের ডালে। কিন্তু গেল ১০ বছরে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে।
পরিবেশ কর্মীরা জানিয়েছেন, আজ থেকে অন্তত ১০ বছর আগেও শীত মৌসুমে খাল-বিল, নদী ও বনজঙ্গলে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। শীত মৌসুমে মহেশখালী, সেন্টমার্টিন, বাঁকখালী ও মাতামুহুরি নদীর তীরে নানা ধরনের পরিযায়ী পাখির আনাগোনায় মুখরিত থাকতো পুরো উপকূল।
বিশেষ করে সেন্টমার্টিন, মহেশখালী , ইনানী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, রামু, হিমছড়ি, চৌফলদন্ডী, পোকখালী, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, নাজিরারটেক ও সোনাদিয়াসহ জেলার উপকূলীয় এলাকায় পরিযায়ী পাখির দেখা মিলতো। পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যেতো বক, ঘুঘু, গাংচিল, শঙ্খচিল, পেলিক্যান, ডাভ, ভাদিহাস ও বালিহাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
মহেশখালীর হোয়ানক কেরুনতলীর বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম জানান, লবণ ও মাছের প্রজেক্টে এক সময় নানা প্রজাতির পাখি দেখা যেতো। জলাশয় ও ফসলের মাঠে এসব পাখি খুবই সুন্দর দেখাতো। ফসলের পোকামাকড় দমন করতে এসব পাখিদের বিশেষ গুণও রয়েছে। কিন্তু এসব পরিযায়ী পাখি এখন আর দেখা যায় না। নানা কারণে এসব পাখির বিচরণ একেবারে কমে এসেছে।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক এইচএম ফরিদুল আলম শাহীন বলেন, পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশের জন্য আশীর্বাদ। এসব পাখি আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। শীত কমে গেলে পরিযায়ী পাখিরা আবার নিজ ভূমিতে চলে যায়। বাংলাদেশে অবকাশযাপনের ইতি ঘটিয়ে আপন ভূমিতে যাওয়ার জন্য আবারও হাজার মাইল পাড়ি দেয় তারা। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনকে সজাগ দৃষ্টি রাখারও আহ্বান জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, খাদ্য-সংকট ও পরিবেশ না পাওয়ার কারণেও ইদানীং পরিযায়ী পাখি আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। নানা কারণের মধ্যে দুটি কারণ হলো যেসব এলাকায় এসব পাখি আশ্রয় নেয়, তার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়া ও শিকারিদের উৎপাত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাকৃতিক নান্দনিক পাখিদের কলরব এখন শুধু স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। বন উজাড় এবং অসাধু শিকারির উৎপাতের কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখি। এক সময় উপকূলীয় এলাকায় পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা ছিল খুব বেশি ছিল। শীতের সময় পৃথিবীর নানা দেশ থেকে লাখ লাখ পরিযায়ী পাখি উপকূলে বেড়াতে আসতো। শীত মৌসুম শেষ হলে আবার তারা বিদায় নিত। উপকূলে এসব পাখির কোলাহলে সমৃদ্ধ হতো পরিবেশ ও প্রকৃতি। এখন সেটি আর দেখা যায় না। কিছু অসাধু শিকারি ও বনজঙ্গল উজাড় পাখি বিলুপ্তির মূল কারণ। নগরায়ন, বৃক্ষবন উজাড়, জলাশয় দখল ও শিকারিদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত অভিযান না থাকায় কক্সবাজার থেকে এসব পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
পাখি বিশেষজ্ঞরা জানান, এ অঞ্চলে অনেক বিপন্ন-মহাবিপন্ন পাখি দেখা যায়। এ বছর পাখি কম দেখা গেছে, এর মানে পাখি কম এসেছে, এমন নয়। হয়তো চোখে পড়েনি। আগামী বছর বেশিও আসতে পারে। তবে ১০ বছরে পাখি কমেছে। পাখি কমে যাওয়ার কারণ হলো পাখির বিচরণক্ষেত্র বিলুপ্ত ও নষ্ট।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, পাখি পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শীতে এ দেশে আসা পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিয়ে বোঝা যায়, পৃথিবীতে এদের সংখ্যা কত, কোন পাখির অবস্থান কোন অঞ্চলে, তা নিরুপণ করা যায়। বাংলাদেশে যদি পাখি আসা কমে যায়, তাহলে মনে করতে হবে এখানে সমস্যা আছে। সমস্যা অনুযায়ী সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এতে পাখিরও উপকার হবে, স্থানীয় মানুষের ও পরিবেশেরও উপকার হবে।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে পাখি নিধন হচ্ছে ঠিক। এ বিষয়ে আমাদের টিম শক্ত অবস্থানে রয়েছে। কোনো অসাধু ব্যক্তি বৃক্ষ, পাহাড় ও পাখি শিকার করার তথ্য পেলেই আমরা শক্ত হাতে দমন করেছি। প্রয়োজনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। মেরিন ড্রাইভ সড়কের আশপাশে এক সময় অনেক পাখির বাস ছিল। কিন্তু হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট হওয়ার ফলে কক্সবাজারে প্রচুর পর্যটক আসছেন এবং রোহিঙ্গাদের কারণে অনেক বন উজাড় হয়ে গেছে। যা পাখিদের অনেক ক্ষতি করছে। তাই পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কেউ পাখি শিকার করে বিক্রি করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং আদালত প্রমাণ পেলে শাস্তি দিচ্ছেন।
পাঠকের মতামত