কক্সবাজার জেলা কারাগার হয়ে উঠেছে ভয়ংকর এক বাণিজ্যকেন্দ্র! বন্দিদের স্বাভাবিক অধিকারও এখানে বিক্রি হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। ভালো সিট, ভালো খাবার, এমনকি স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ-সব কিছুই মিলছে মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে। আর যার টাকা নেই? তার জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ংকর নির্যাতন, ডান্ডাবেড়ির শেকল, কিংবা ‘ছোলা চোর’ অপবাদ। ডান্ডাবেড়ি থেকে মুক্তি দিতে নেওয়া হয় হাজার হাজার টাকা।
অভিযোগ উঠেছে, কক্সবাজার কারাগারের জেলার আবু মুছার নেতৃত্বে চলছে দুর্নীতির এই মহোৎসব। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। বন্দিদের ওপর বর্বর নির্যাতন, টাকার বিনিময়ে ডান্ডাবেড়ি থেকে মুক্তি, এমনকি কারা হাসপাতালকে বিলাসবহুল বিশ্রামাগারে পরিণত করার মতো ঘটনা নিয়মিত চলছে এখানে।
চুরির অভিযোগে ছয় হাজতির ওপর ভয়াবহ নির্যাতন : ৩ মার্চ সন্ধ্যায় এক নির্মম ঘটনার জন্ম দেন জেলার আবু মুছা। অভিযোগ, কারাগার থেকে ‘ছোলা চুরি’র অভিযোগে ছয় হাজতিকে ক্যাশ টেবিলে ডেকে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালান তিনি। মারধরের শিকার বন্দিরা হলেন-মাতামুহুরী ২ নম্বর ওয়ার্ডের সুদে আলম, প্রকাশ লালু, আনোয়ার, মো. আলম, সৈয়দ আলম, নুরুল আমিন ও লতিফ।
সদ্য মুক্তি পাওয়া হাজতি শাহারিয়ার জানান, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তাদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়। কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়াই তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এখনো তারা কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
ডান্ডাবেড়ির ভয়ংকর বাণিজ্য : ডান্ডাবেড়ি সাধারণত কুখ্যাত অপরাধীদের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কক্সবাজার কারাগারে এটি পরিণত হয়েছে চাঁদাবাজির হাতিয়ারে! ফেব্রুয়ারিতে কারা ক্যান্টিনের হিসাবে গরমিলের অজুহাতে সাতজন বন্দিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে সেলে আটকে রাখেন জেলার আবু মুছা। পরে তাদের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করা হয়।
ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়েছিল ক্যান্টিন ইনচার্জ মুন্না, খাইরুল আমিন, রহমান, শফি আলম, জাফর, পিসি ইনচার্জ সাদেক ও হাবিবকে। পরে পাঁচজনকে মুক্তি দেওয়া হলেও সাদেক ও হাবিব এখনো শেকলে বন্দি রয়েছেন।
কারা হাসপাতাল এখন ইয়াবা কারবারিদের বিশ্রামাগার : কারা হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ বন্দিরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। বরং হাসপাতালটি হয়ে উঠেছে ইয়াবা কারবারি ও রাজনৈতিক নেতাদের জন্য ‘বিশেষ বিশ্রামাগার’। এখানে সিট পেতে হলে প্রথমে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। এরপর মাসিক ১৫-২০ হাজার টাকা দিতে হয় কারা কর্মকর্তাদের। বর্তমানে এই হাসপাতালে ৪০-৪৫ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা টাকার বিনিময়ে আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চলছে। বড় নেতাদের ৫০ হাজার এবং ছোট নেতাদের ২০-৩০ হাজার টাকা দিয়ে হাসপাতালে জায়গা নিতে হচ্ছে। যাদের সামর্থ্য কম, তারা ফ্লোরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, সেখানেও মাসিক ১০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে!
এক বন্দি বলেন, আমি কিডনির সমস্যাসহ নানা রোগে ভুগছিলাম। তিন দিন হাসপাতালে থেকেও কোনো চিকিৎসক পাইনি। শুধু ফার্মাসিস্ট ব্যথানাশক ইনজেকশন ও ট্যাবলেট দিয়েছেন।
অন্য এক ভুক্তভোগী বলেন, অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জেলার আবু মুছাকে অনুরোধ করলাম, স্যার আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠান। তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন, মৃত্যুর আগে কারও বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এতে কারাগারের গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
এদিকে বন্দিদের নিুমানের খাবার দেওয়া হয়। বন্দিরা যেন বাধ্য হয়ে কারা ক্যান্টিন থেকে খাবার কেনে, তাই সেখানে কয়েক গুণ বেশি দামে খাবার বিক্রি করা হয়। প্রথম রমজানে বন্দিরা এই জালিয়াতির প্রতিবাদ জানালেও কোনো ফল হয়নি। জেলার আবু মুছার আস্থাভাজন কারারক্ষী মিজান পুরো কারা হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করেন।
জেলার আবু মুছার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় : জেলার আবু মুছার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততারও অভিযোগ রয়েছে। তার সিন্ডিকেটের কিছু কারারক্ষী রাতে হাজতিদের কাছে মাদক সরবরাহ করেন। ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর কারারক্ষী এমদাদ রাত ২টা ৪৪ মিনিটে মাদকের চালান নিয়ে কারাগারে প্রবেশ করেন। পরে বন্দিদের মধ্যে মাদক বিক্রি নিয়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানার পর জেলার নিজেই মাদকগুলো ‘বিস্কুট’ বলে চালিয়ে দেন।
কারাগারের প্রধান ফটকের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষী আব্দুল গফুর এক সময় কুমিল্লা কারাগারে মাদকসহ ধরা পড়েছিলেন। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু জেলার আবু মুছা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাকে আবার দায়িত্ব দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জেলার আবু মুছার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও উত্তর দেননি।
কক্সবাজার কারাগারের জেলার আবু মুছার অনিয়মের বিষয়ে জেল সুপার জাবেদ মেহেদীর কাছে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থেকে তার সঙ্গে কারাগারের অফিসে দেখা করার অনুরোধ করেন। পরে কয়েদি-হাজতিদের ওপর জেলারের নির্যাতন ও নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন জানিয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক মহাসচিব নূর খান লিটন বলেন, বিনা অপরাধে বন্দিদের নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। শারীরিকভাবে আঘাত করা হলে সেটি জেল কোড লঙ্ঘন। সুত্র,যুগান্তর