উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
কক্সবাজার জেলা কারাগারে দালাল ছাড়া বন্দিদের সাথে সাক্ষাৎ করা যায়না। কারাগারের বাইরে ও কক্সবাজার শহরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত এসব দালাল চক্রের সদস্যরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কারাবন্দিদের সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে থাকেন। অফিস কলের নামে বন্দিদের সাথে প্রতিবার সাক্ষাতে স্বজনদের কাছ থেকে এ দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে ১২শ থেকে ১৫শ টাকা পর্যন্ত। আর নিয়মিত সাক্ষাতের জন্য দায়িত্বরত কারারক্ষীরা একেকজন বন্দির সাথে দেখা করতে ৩০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন। এ অবস্থায় প্রতিদিন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা কয়েক হাজার সাক্ষাৎপ্রার্থী বন্দি স্বজনের সাক্ষাৎ না পেয়েই ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, জেলা কারাগারে আটক বন্দির সাথে সাক্ষাতে অফিস কলের নামে ১২শ থেকে ১৫শ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। কক্সবাজারের একটি দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারাগার কতৃপক্ষ এই টাকা আদায় করে থাকে। এই সিন্ডিকেটটি প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ জন দর্শনার্থীকে অফিস কলের সাক্ষাতের সুযোগ দিয়ে গড়ে প্রতিদিন দেড় লাখা টাকা আদায় করছে।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার কারাগারের জেল সুপার বজলুল রশিদ আকন্দ ও জেলা'র সাখাওয়াত হোসেন স্থানীয় কয়েকজন দালালকে দিয়ে করাগারে অফিস কলে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার দায়িত্ব দিয়েছেন। কক্সবাজারের রাশেল, রুবেল ও সেলিম নামের একটি দালাল চক্র কক্সবাজার শহরে কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় অবস্থান করে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা আদায় করে বন্দিদের সাক্ষাতের অনুমতি দেয়। দিন শেষে টাকাগলো দালাল চক্রটিসহ কতৃপক্ষের সাথে ভাগবাটোয়ারা করে। প্রতিদিন ঐ দালাল চক্রটিকে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়।
নিয়ম অনুযায়ী কক্সবাজার কারাগারে সাধারন দক্ষনার্থীদের ৫ টাকা দিয়ে রশিদ নিয়ে বন্দির সাথে সাক্ষাৎ করা যায়। প্রতিদিন দুই শতাধিক সাক্ষাৎ প্রার্থী কারাগারে র টাকা দিয়ে রশিদ নিয়ে থাকে। কিন্তু অর্ধেকের বেশি সাক্ষাৎ প্রার্থী বন্দিদের সাথে দেখা না করে চলে যাচ্ছেন। বাকীরা ফিরে যান দায়িত্বরত কারা রক্ষীদের দাবিকৃত ঘুষ দিতে না পারার কারণে।
ভূক্তভোগীরা অভিযোগ করে আরও জানান, বন্দিদের সাথে দেখা করতে ৫ টাকা দিয়ে রশিদ ক্রয় করে ঘন্টার পর ঘন্টা গেইটের বাইরে অপেক্ষা করতে হয়। পরে বন্দির নাম-ঠিকানা নিয়ে সাক্ষাৎ কক্ষে ডেকে আনা হয়। আর বন্দিকে সাক্ষাতে ডেকে আনতে কারা রক্ষীরা ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবী করে থাকে।
দেনদরবার করে সর্বনিন্ম ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে রফাদফা হয়। এর পরই বন্দিকে ডেকে এনে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। আর যারা দাবীকৃত টাকা দিতে পারেন না তাদের সারাদিন অপেক্ষা করে বিকালে ফিরে যেতে হয়। এমনকি অনেক সাক্ষাৎ প্রার্থীকে টিকেট দিলেও তা এন্ট্রি করা হয়না।
এ অবস্থায় চকরিয়া, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, টেকনাফ, রামু , উখিয়া সহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা লোকজন বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
বিশেষ করে দূর থেকে আসা গরীব ও অসহায় লোকজনই হয়রানির শিকার হচ্ছেন অধিক। ঘুষ দিতে না পেরে আপনজনের দেখা না পেয়ে তারা কান্নাকাটি করেই ফিরে যাচ্ছেন গন্তব্যে। এতে কারাগারের বাইরে এক হ্নদয়বিদারক দৃশ্যের দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে সাক্ষাত করতে আসা আবদুর রহিম পূর্বপশ্চিমকে বলেন ‘আগে এমন অবস্থা ছিল না। বকশিস হিসেবে টাকা দিলে দ্রুত বন্দি ডেকে এনে দেখার ব্যবস্থা করে দেয়া হতো। কিন্তু গত ৫/৬ মাস ধরে ডাকাতের মতো টাকা আদায় করছে কারারক্ষীরা। যার কারণে অনেকেই বন্দির সাথে সাক্ষাৎ করতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন।’
টেকনাফের জাফর আহম্মদ পূর্বপশ্চিমকে বলেন, ‘কারাগারে বন্দি আমার খালাতো ভাইকে সাধারন ফটকে দেখতে গিয়ে ৫০০ টাকা দাবী করে কারারক্ষীরা। অনেক দেনদরবার করে ৩০০ টাকা দিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করি।’
কক্সবাজার শহরের সমিতি পাড়ার রোকসানা আকতার বলেন, ফিস কলে স্বামীর সাথে দেখা করতে কারাগারে গেলে রাশেল নামের এক দালালের সাথে দেখা করার জন্য একটি নাম্বার দেয়া হয়।
ঐ নাম্বারে যোগাযোগ করলে দালাল রাশেল ‘আমার কাছ থেকে ২০০০ টাকা দাবী করেছিল। পরে ১৫০০ টাকা বিকাশে দিয়ে সাক্ষাৎ করি।’
জাহেদা বেগম নামের আরেক নারী জানিয়েছেন , ‘কারাগারে বন্দি ভাইকে অফিস কলে দেখতে কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় রুবেলের সাথে দেখা করে ১৫০০ টাকা দিয়ে অনুমতি নিয়ে কারাগারে ৫ মিনিটের জন্য অফিস কলে সাক্ষাত করি।
দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী থেকে আসা কবির আহমদ পূর্বপশ্চিমকে বলেন, ‘আমার ছেলে একটি পারিবারিক মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দি আছে। নিয়ম অনুযায়ী টাকা দিয়ে টিকেটও নিয়েছি। এরপরও ঘুষ দিতে না পারায় দেখা হয়নি।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কারাগারের কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের লোভী করে তুলেছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ঘুষের টাকায় তারা অন্ধ হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষকে তারা আর চোখেই দেখছে না।’
তিনি বলেন, ‘যেসব ইয়াবা ব্যবসায়ী কারাগারে বন্দি আছে, তারাতো টাকা দিতে পারে। কিন্তু যারা গরীব অসহায় সাধারণ মামলায় বন্দি তাদেরকে হয়রাণী করলে তারা কোথা থেকে টাকা এনে দেবে?’
চকরিয়া থেকে আসা আরেক ব্যক্তি বাপ্পী পূর্বপশ্চিমকে বলেন, ‘কারাগারে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের ডাকার করার জন্য যে সাউন্ড বক্স রয়েছে সেটিও নষ্ট। ওই সাউন্ড বক্সে ডাকলেও শোনা যায় না। ঘুষ আদায় করতেই হয়তো সাউন্ড বক্সটি কৌশলে বন্ধ রাখা হয়েছে।’
বন্দিদের সাথে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের এমন হয়রাণী ও দূর্ভোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মো. বজলুর রশিদ আখন্দ পূর্বপশ্চিমকে বলেন, ‘অফিস কলের নামে দালাল সিন্ডিকেট দিয়ে টাকা আদায়ের কথা অস্বিকার করেন।
তিনি বলেন রাশেল ও রুবেল তার পূর্ব পরিচিত। তাই তারা মাঝে মাঝে কারাগারে আসেন। তবে তারা দালাল নয়। তবে এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটে থাকলে কালই আমি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব। সুত্র:পূর্বপশ্চিম