সেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও::
কক্সবাজার জেলায় সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি প্রতিবছর বাড়ছেই। সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, একের পর এক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই। অথচ যা সতর্কতা অবলম্বন ও যথাযথ আইন মান্য করলে অনেকটাই এড়ানো সম্ভব। গত তিন বছরে কক্সবাজার জেলায় ৯০০ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৩১ জন। আর চলতি বছরের ১২ মে পর্যন্ত ৯৮টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ২১ জনের। ১৫৮ কিলোমিটারের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৭৭ কিলোমিটার রয়েছে কক্সবাজার অংশে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কক্সবাজারের সভাপতি জসিম উদ্দিন কিশোর বলেন, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশাপাশি বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সড়কে দুর্ঘটনায় লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিবছর দুর্ঘটনা বেড়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। তিনি আরও জানান, প্রশিক্ষণবিহীন চালক, মুঠোফোনে কথা বলা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ওভারটেক, দ্রুতগতি, অতিরিক্ত মালবোঝাই, ভাঙাচোরা সড়ক, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে সতর্ক চিহ্ন না থাকা, মহাসড়কে লবণবোঝাই ট্রাক চলাচল, নির্ঘুম থাকা, নেশাগ্রস্ত চালক ও ট্রাফিক আইন না মানাকে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চলতি বছরে বড় দুর্ঘটনা ঘটে ৩ মে।
মহাসড়কের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী সেনাক্যাম্প–সংলগ্ন এলাকায় যাত্রীবাহী বাস-জিপের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা গেছেন মা-মেয়েসহ পাঁচজন। দুর্ঘটনার সময় বাসের চালক মুঠোফোনে কথা বলছিলেন।
এ ছাড়া ২০১৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে মাতামুহুরী সেতুর রেলিং ভেঙে পর্যটকবাহী বাস নদীতে পড়ে নারী-শিশুসহ ১৮ জনের মৃত্যুর ঘটনা সারা দেশে আলোচিত হয়। নতুন সড়কে এসে গতিপথ বুঝতে না পারা ও চালকের আধো ঘুমকে এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর তথ্যমতে, কক্সবাজার জেলায় ২০১৩ সালে ৩০২টি দুর্ঘটনা ঘটে। মারা যায় ৪১ জন। ২০১৪ সালে ৩০৫টি দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪৪ জন। ২০১৫ সালে ৩০৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬ জন মারা গেছে। তিন বছরে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষ।
তবে নিসচার দেওয়া তথ্যের সঙ্গে হেরফের রয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথিরিটির (বিআরটিএ) কক্সবাজার কার্যালয়ের হিসাবের। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে জেলায় ৮৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৬ জন মারা গেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন মাত্র ৮৩ জন।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএ’র কক্সবাজার জেলার সহকারী পরিচালক পার্কন চৌধুরী বলেন, ‘পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা সড়ক দুর্ঘটনার হিসাব রাখি। নিসচার তথ্যের সঙ্গে হেরফেরের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।’
নিসচার কর্মকর্তা, হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার আজিজ নগর থেকে খুটাখালী ইউনিয়নের নতুন অফিস পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
তিন বছরে এসব স্থানে ৪৫টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮৭ জন। আহত হয়েছেন অন্তত ৪০০ জন। এ ছাড়া কোনো লোক মারা যায়নি এ রকম দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২৯৫টি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ঘেঁটে এই তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের ৩ মে পর্যন্ত কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের গয়ালমারা এলাকায় ১১টি, বরইতলী ইউনিয়নের বানিয়ারছড়া ঢালা এলাকায় নয়টি, ডুলাহাজারার মালুমঘাট, চকরিয়া পৌরসভার মৌলভীরকুম, খুটাখালী ইউনিয়নের নতুন অফিস ও খুটাখালী বাজার এলাকায় তিনটি করে এবং ফাঁসিয়াখালীর হাঁসেরদীিঘ, ডুলাহাজারার সাফারি পার্ক ও হারবাংয়ের ইনানী রিসোর্ট এলাকায় দুটি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার প্রতিটিতে প্রাণহানি হয়েছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দুর্ঘটনা প্রবণ মোড় হচ্ছে হারবাং লালব্রিজ, ইসলামনগর, ভেন্ডিবাজার মোড়, আজিজ নগর উত্তর গেট মোড়, বরইতলী রাস্তার মাথা, নলবিলা চেকপোস্ট এলাকা, চকরিয়া কলেজ মোড়, মালুমঘাট ছগিরশাহ কাটা, দরগাহ গেট, খুটাখালী মেধাকচ্ছপিয়া ঢালা, নাপিতখালী খেলার মাঠ মোড়, নাপিতখালী হাইস্কুল মোড়, ডুলাফকির মোড়, পানিরছরা, গুচ্ছগ্রাম, সদরের খরুলিয়া আলাউদ্দিনশাহ দরগাহ এলাকা, ইসলামাবা নতুন রাস্তার মাথা, খরুলিয়া সমিল এলাকা ও বাংলাবাজার।
এ ছাড়া কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ মোড় হচ্ছে বেসিক, পানের ছড়া, রাবেতা, মরিচ্যাবাজার, উখিয়া বাজার, বালুখালী, উলবনিয়া, খঞ্জরপাড়া, নয়াপড়া, লেদা, জাদিমুরা ও নয়াবাজার। এসব মোড়ে দুর্ঘটনা ঘটে বেশি।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চকরিয়া উপজেলা শাখার সভাপতি ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ সেন্টার নেই। অশিক্ষিত চালকের কারণে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন ধরার ক্ষেত্রেও ট্রাফিক পুলিশকে কাজ করতে হবে। ম্যাজিক, মাহিন্দ্রা, সিএনজি অটোরিকশা ইত্যাদি গাড়ির অধিকাংশ নম্বরবিহীন। এসব গাড়ি চালান অদক্ষ চালকেরা।
তিনি আরও বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ মোড়ে সাইনবোর্ড স্থাপন, প্রশিক্ষণ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স না দেওয়া, চালকদের সচেতন করতে এলাকাভিত্তিক ভিডিও প্রদর্শনীর ব্যবস্থার উদ্যোগ নিলে দুর্ঘটনা কমতে পারে।
আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক ও কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক কামাল আজাদ বলেন, সব চালক অদক্ষ নন। মূল সমস্যা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলোতে সতর্কতার সাইনবোর্ড না থাকা। ফলে জেলার বাইরে থেকে আসা চালকেরা বাঁক বুঝতে পারেন না, তাঁরা দুর্ঘটনায় পড়েন। তবে তিনি চালকদের প্রশিক্ষণ না থাকার কথা স্বীকার করেন।
কক্সবাজারের সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) আব্দুস সালাম বলেন, কিছু কিছু চালক আছেন, যারা সড়কে গাড়ি চালানোর সময় রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামেন। অসম গতির গাড়ি, যত্রতত্র পার্কিং ও অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।
পাঠকের মতামত