সদর হাসপাতালে যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে আইসিইউ, সিসিইউসহ বিশেষায়িত সেবা
জেলা জুুড়ে স্বাস্থ্য সেবায় আবারও বিপর্যয়ের আশংকা তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটে স্থানীয়দের জন্য বিশ্বব্যাংকের বরাদ্দ অর্থে পরিচালিত স্বাস্থ্য বিভাগের প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রকল্পের অর্থ সংকটের কারণে গত ৩০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োগ প্রাপ্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারি চাকুরি হারিয়েছেন।
এতে যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যাবে জেলা সদর হাসপাতালের আইসিইউ, সিসিইউ সহ বিশেষায়িত সেবা। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন হাসপাতাল সহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনেক সেবাই বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ সেবা বন্ধ হয়েছে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও।
তবে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংকট নিরসনে ইনক্লুসিভ সার্ভিসেস অপারেটিং (আইএসও) নামে একটি সংস্থার অধীনে নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। মন্ত্রণালয়ে পাশ ও ইউএন সংস্থার সাথে সাক্ষর হলে প্রকল্পটি শুরু হবে। তবে তা কবে শুরু হতে পারে তা নিশ্চিত নয়।
কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয় ও জেলা সদর হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাংকের ‘স্বাস্থ্য ও জেন্ডার সাপোর্ট প্রকল্প (এইচজিএফপি), স্বাস্থ্য ও লিঙ্গ সহায়তা প্রকল্প (এইচজিএস) অধীনে রোহিঙ্গা সংকটে স্থানীয়দের জন্য বিশ্বব্যাংকের বরাদ্দ অর্থে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিভিন্ন এনজিও জেলাব্যাপী হাসপাতাল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জনবল নিয়োগ সহ নানা সহায়তা করে আসছিল ২০১৯ সালের শুরু থেকে।
এতে কক্সবাজার স্বাস্থ্য বিভাগে সরকারিভাবে নিয়োগ করা জনবল ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের অধীনে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারি রয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সেন্টমার্টিন হাসপাতাল, জেলার ৭২ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এই সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারি দায়িত্ব পালন করে আসছিল।
গত ৩০ জুন এই প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ না থাকায় জনবল প্রত্যাহারের চিঠি প্রদান করেছিল সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারি সংস্থা। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারের নানা পর্যায়ে চিঠি প্রেরণ করে জানানো হয়। এর প্রেক্ষিতে ১ জুলাই বিশ্বব্যাংকের পক্ষে প্রেরিত এক চিঠিতে এসব প্রকল্প ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। পরবর্তি ৬ মাসও প্রকল্প চালু রাখার কথা থাকলেও হঠাৎ করে ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ না থাকায় আবারও বন্ধ করে দেয়া হয় এসব প্রকল্প।
এতে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আইসিইউ, সিসিইউ সহ বিশেষায়িত সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জেলা সদর মডেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আশিকুর রহমান জানিয়েছেন, স্থানীয় জনগোষ্ঠির কল্যানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৬ টি সংস্থার অধীনে ১৯৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির পদায়ন রয়েছিল কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। যেখানে আইসিইউ ও সিসিইউ পরিচালনার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহ মোট ৪৬ জন চিকিৎসক ছিলেন। এছাড়া রয়েছেন নার্স ও মিডওয়াইফ ১৩ জন, বায়ো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ান ১ জন, মেডিকেল টেকনোলজিস ৫ জন, ল্যাবোরেটরি টেকনোলজিস ২ জন, রেডওলজি টেকনোলজিস ২ জন, লাইফ অপারেটর ১ জন, অ্যাম্বুলেন্স চালক ১ জন, বৈদ্যুতিক কারিগারি ১ জন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ৩৮ জন, ওয়ার্ড মাস্টার ১ জন, আনসার সদস্য ১৫ জন, নিরাপত্তা কর্মী ৭ জন, ওয়ার্ড বয়/আয়া ২০ জন, অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) সহযোগি ৬ জন, সিনিয়র ফার্মাসিস্ট ১ জন, ল্যাব সহকারি ২ জন, স্টোরকিপার ১ জন, ডাটা অপারেটর ১ জন, আইএমসআই বিশেষজ্ঞ ২ জন, ক্লিনিক্যাল বিশেষজ্ঞ ৪ জন, সমন্বয়কারি ১ জন, চক্ষুবিশেষজ্ঞ ১ জন, টিকেট বিভাগে ৫ জন, ম্যানুয়ার ওর্য়াকার ১০ জন, কেস ওর্য়াকার ২ জন, ইডি সহযোগি ৮ জন, স্যানিটারি কর্মী ১ জন।
এর বিপরীতে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের সরকারি মঞ্জুরিকৃত ৩২৮ টি পদের মধ্যে ৭৬ টি শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর ৬৮ টি চিকিৎসকের পদে কর্মরত রয়েছেন ৫২ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীর নার্সের ১৮০ টি পদে কর্মরত রয়েছেন ১৫৭ জন, তৃতীয় শ্রেণীর ৩৬ পদে ৩১ জন এবং চতুর্থ শ্রেণীর ৪৪ পদে ১২ জন কর্মরত রয়েছেন।
আর এনজিওর এই জনবল না থাকলে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের হাসপাতালটি ভর্তি রোগী, বহিঃ বিভাগ ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সেবায় বিপর্যয় নেমে আসার আশংকা করে তিনি বলেন, জরুরি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৫ শতাধিক রোগী সেবার জন্য আসেন। ৩০ সেপ্টেম্বরের পর মাত্র তিনজন চিকিৎসক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবা দিতে আমরা যেমন হিমশিম খাচ্ছি তেমনি রোগীদের জন্যও ভোগান্তির। যদি নুন্যতম সেবা চালু রাখতে হয় তাহলে জরুরি বিভাগে অন্তত ১২ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। এছাড়া ২৫০ শয্যার হলেও হাসপাতালে আন্তঃবিভাগে গড় হিসেবে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ রোগী ভর্তি থাকেন। বর্তমানে চিকিৎসক না থাকায় জরুরি প্রসূতি ও শিশু বিভাগ এবং আউটডোরে ইএমটি বিভাগে চিকিৎসক সংকটের কারণে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, জেলা সদর হাসপাতালের অর্গানোগ্রাম হিসেবে সাধারণত আইসিইউ, সিসিইউ এবং স্ক্যানু বিভাগ থাকেনা। কিন্তু নানা গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার বিশেষায়িত এসব সেবা চালু করে। ১০ শয্যার আইসিইউ চালু রাখতে রোস্টার মতে কমপক্ষে ১৬ জন ডাক্তার প্রয়োজন এবং সিসিইউতে ৮ জন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ দুই বিভাগে বর্তমানে আমাদের ডাক্তার রয়েছে একজন করে। চিকিৎসক পাওয়া না গেলে বিশেষায়িত এসব সেবা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোন গতি থাকবে না। তাই অব্যাহত রোগীর চাপ, জনগণের সন্তুষ্টি অর্জন এবং মানসম্মত সেবা নিশ্চিতে বিদ্যমান সরকারি জনবলের সাথে সাপোর্ট হিসেবে অতিরিক্ত চিকিৎসক প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকের পাশাপাশি প্রকল্প শেষ হওয়ায় সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্লিনার, আয়াসহ ১৪৭ জনের চাকুরী নেই। ফলে পরিচ্ছন্নতা নিয়েও বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে হাসপাতালটিতে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, জেলার ২৫ লাখ মানুষের সাথে ২০১৭ সালে যোগ হয়েছে ১২ লাখ রোহিঙ্গা। আর প্রতিবছর কক্সবাজারে বেড়াতে আসে কয়েক লাখ পর্যটক। বিপুল জনগোষ্ঠীর উন্নত সেবার আধুনিক সেবা প্রতিষ্টান ২৫০ শয্যার কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার হলেও মূলত এখানে এটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হিসেবে সেবা দিতে হচ্ছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী জরুরি ও বর্হি:বিভাগে সেবা নিতে আসেন। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০শত রোগী ভর্তি থাকে। আন্তঃবিভাগে জরুরি প্রসূতি ও শিশু চিকিৎসক এবং বহির্বিভাগে নাক, কান, গলা (ইএমটি) চিকিৎসক নেই। অথচ রোগী অনুপাতে চিকিৎসক নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
সিভিল সার্জন বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, কক্সবাজার স্বাস্থ্য বিভাগে সরকারিভাবে নিয়োগ করা জনবল ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের অধীনে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল ছাড়াও উখিয়া হাসপাতালের ৯২ জন, টেকনাফ হাসপাতালের ৮০জন, সেন্টমার্টিন হাসপাতালের ১৬ জন, পেকুয়া হাসপাতালে ৫২ জন, চকরিয়া হাসপাতালে ৪৬ জন কর্মকর্তা কর্মচারি দায়িত্ব পালন করছিল। এছাড়া ৭২ টি ইউনিয়ন হাসপাতালে ৩ শতাধিক কর্মী দায়িত্ব পালন করছিল। ওখানে সেবা বিপর্যয় হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার মং টিং ঞো বলেন, এনজিও প্রকল্প বন্ধ হওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। তবে ইনক্লুসিভ সার্ভিসেস অপারেটিং (আইএসও) নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা নতুন একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে। আশা করছি প্রকল্পটি অনুমোদন হবে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডাক্তার আসিফ আহমেদ হাওলাদারও একই আশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি চালু করা জরুরি।
আইএসও এর প্রকল্প পরিচালক বিপাশ খিসা বলেন, প্রকল্পটি আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেখানে পাশ হলে ইউএন এজেন্সির সাথে চুক্তি সাক্ষর হলে চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হবে। তবে কবে প্রকল্পটি পাশ হবে তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।