লবণবাহী ট্রাক থেকে পড়া পানিতে বাড়ছে দুর্ঘটনাপ্রবণতা লবণাক্ততায় কমছে সড়কের আয়ুষ্কাল ভেজা লবণ বোঝাইয়ে মানা হচ্ছে না পলিথিনের ব্যবহার
এশিয়ান করিডোরে যুক্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাইকার অর্থায়নে এই মহাসড়কের পটিয়ার ইন্দ্রপুল অংশ ছয় লেনে উন্নীত করা হয়। সেতুটিও ছয় লেনের। লবণবাহী ট্রাকের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলে সড়কটিতে বাড়ছে দুর্ঘটনাপ্রবণতা। লবণাক্ত পানি পড়ে কমছে সড়কের আয়ুষ্কাল।
সড়ক বিভাগ বলছে, শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ করা হয়। শুধু লবণপানির কারণেই বিটুমিন সড়কের স্থায়িত্ব ও আয়ুষ্কাল কমে যায়। সড়ক পিচ্ছিল হয়ে ঘটে দুর্ঘটনা।
গণপরিবহন চালক ও যাত্রীদের অভিযোগ, ইন্দ্রপুল লবণ কারখানাগুলোতে আসা ট্রাক থেকে পড়া লবণপানি মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলেও লবণ কারখানা মালিকদের কোনো কর্ণপাত নেই। তারা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মহাসড়কেই লবণবাহী ট্রাকের স্ট্যান্ডে পরিণত করেছেন। সড়কে লবণপানি পড়া এড়াতে ভেজা লবণ পরিবহনে ট্রাকে সঠিকভাবে পলিথিন ব্যবহারের কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
ইন্দ্রপুলে একটি ট্রাক টার্মিনাল ছিল, কিন্তু সেতু ও সড়ক সম্প্রসারণের সময় ট্রাক টার্মিনালের জায়গা নিয়ে নেয় রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে। তারা ইন্দ্রপুলের সড়কটি করতে আমাদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনাই করেননি।- ইন্দ্রপুল লবণ মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল কাদের
জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পর দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক’। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে বাংলাদেশের প্রধান আন্তর্জাতিক সড়ক নেটওয়ার্কে (এশিয়ান করিডোর) যুক্ত করার মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সহজতর করতে মহাসড়কটির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা হয়। বিশেষ করে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (সিবিআরএনআইপি) আওতায় মহাসড়কটিতে ইতোমধ্যে ৭৫১ কোটি টাকার চারটি ছয় লেনের সেতু নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম পটিয়ার ইন্দ্রপুল সেতু। গত কয়েক মাস আগে ব্যবহারের জন্য পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয় ছয় লেনের সেতুটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, ইন্দ্রপুল অংশে বেশ কয়েকটি লবণবোঝাই ট্রাক মহাসড়কটির উত্তরাংশে দাঁড় করানো। ট্রাকগুলো থেকে লবণপানি পড়ছে সড়কে সরাসরি। চলাচালকারী যানবাহনের চাকায় সেই পানি ছড়িয়ে পড়ছে পুরো সড়কে। স্যাঁতসেঁতে হয়ে তৈরি হচ্ছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা।
শুক্রবার (৭ মার্চ) ইন্দ্রপুলের সেই লবণপানি পড়া স্থানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখা যায়, রাস্তায় পড়া লবণপানি একসময় রোদে শুকিয়ে শুকনো লবণের মতোই সাদা বর্ণ ধারণ করছে। দ্রুতগতির কোনো যানবাহন হঠাৎ ব্রেক কষলেই হারাতে পারে নিয়ন্ত্রণ।
লবণপানি বিটুমিন সড়কের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এতে সড়কের যে বাইন্ডিং, সেটি নষ্ট হয়ে যায়। আয়ুষ্কাল কমে যায়। দ্রুত সড়কে গর্ত তৈরি করে। আবার লবণপানিতে ভেজা বিটুমিন সড়ক খুবই পিচ্ছিল হয়। এতে দুর্ঘটনাপ্রবণতা বাড়ে। শুধু লবণপানির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণহানিও হয়।-চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা
ইন্দ্রপুলে দাঁড়িয়ে কথা হয় বাইকচালক জিতু কান্তি দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে সব সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে। প্রতিদিন রাতে লবণভর্তি ট্রাক এসে রাস্তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। লবণপানিতে পুরো সড়ক সয়লাব হয়ে যায়। সকালে দেখা যায় পুরো সড়ক কর্দমাক্ত।’
তিনি বলেন, ‘এখানে বাইকাররা দুর্ঘটনার শিকার হন। লবণপানির পিচ্ছিলতার কারণে এ জায়গায় ব্রেক কাজ করে না। লবণমিলে আসা ট্রাকগুলো যদি মহাসড়কের বাইরে অবস্থান করে তাহলে অন্তত অবস্থানকালীন যে লবণপানি সড়কে পড়ে, সেগুলো আর পড়বে না।’
স্থানীয় বাসিন্দা মো. বেলাল বলেন, ‘এখানে লবণের পানির কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। লবণবাহী ট্রাকগুলো সড়কের ওপর যত্রতত্র রাখছে। ট্রাক থেকে লবণপানি গলে পুরো সড়ক ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর লবণপানিতে পুরো সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে।’
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের নিয়মিত বাস চালক কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় ট্রাকগুলো আসার পথে পুরো সড়কেই পানি পড়ে। ট্রাক থেকে সড়কে পানি পড়ে যাওয়ার জন্য অনেক ট্রাকে ছোট নলও সেট করা রয়েছে। কিন্তু মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশ থাকলেও লবণপানি পড়া রোধে তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’
তিনি বলেন, ‘সকাল ও সন্ধ্যায় পুরো সড়ক লবণপানিতে ভিজে থাকে। অনেক স্থানে কর্দমাক্ত হয়ে যায়। তখন প্রয়োজনে গাড়ি ব্রেক কষলে বিপাকে পড়তে হয়। অনেক সময় চালক গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না। তখন দুর্ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যেসব বাস দুর্ঘটনায় পড়ে তার বেশিরভাগই হচ্ছে লবণপানির কারণে।’
লবণপানির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি ক্রমেই দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠছে। লবণপানির পিচ্ছিলতার কারণে বেশিরভাগ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সম্প্রতি ইন্দ্রপুল অংশ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।-পটিয়া ক্রসিং হাইওয়ে থানার ওসি) মো. জসিম
ইন্দ্রপুলের স্থানীয় লবণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন লবণের ভরা মৌসুম। কক্সবাজার জেলার বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় চকরিয়া, মগনামা, পেকুয়া এলাকায় উৎপাদিত লবণ ট্রাকে করে ইন্দ্রপুলের লবণ কারখানাগুলোতে আসে। প্রতিদিন গড়ে আসে ২০-৪০ ট্রাক কাঁচা লবণ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইন্দ্রপুল লবণশিল্প অনেক পুরোনো। আগে চাঁনখালি খাল দিয়ে নৌকাযোগে লবণ আসতো। তখন ইন্দ্রপুলে কোনো ট্রাকস্ট্যান্ড ছিল না। চাঁনখালি খাল দীর্ঘসময় ধরে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বেশ কয়েক বছর ধরে ট্রাকে করে কাঁচা লবণ পরিবহন করা হয়। ট্রাকে লবণ পরিবহন শুরু হলে ইন্দ্রপুলে ট্রাক টার্মিনাল করার পদক্ষেপ নেয় পটিয়া পৌর কর্তৃপক্ষ।
বিশেষ করে ইন্দ্রপুল লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ পটিয়া পৌরসভার মেয়র হওয়ার পর তিনি ইন্দ্রপুলে মহাসড়কের পাশে একটি ট্রাকস্ট্যান্ড তৈরির উদ্যোগ নেন। পরবর্তীসময়ে দুই লেনের পুরোনো সেতু ভেঙে ছয় লেনের সেতু ও সড়ক করার উদ্যোগ নেওয়া হলে ট্রাক টার্মিনালের জায়গাটি মহাসড়কের মধ্যে নিয়ে নেয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এই সুযোগে গত বছর থেকে মহাসড়কের ওপরই লবণবোঝাই ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখছেন এখানকার মিল মালিকরা।
ইন্দ্রপুল লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশিদ গত ৫ আগস্ট থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে কথা হলে ইন্দ্রপুল লবণ মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইন্দ্রপুলে একটি ট্রাক টার্মিনাল ছিল, কিন্তু সেতু ও সড়ক সম্প্রসারণের সময় ট্রাক টার্মিনালের জায়গা নিয়ে নেয় রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে। তারা ইন্দ্রপুলের সড়কটি করতে আমাদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনাই করেননি।’
সঠিকভাবে সড়কটি করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন লবণের ভরা মৌসুম। বর্ষা আসার আগেই মাঠ থেকে লবণ সংগ্রহ করতে হয়। না হলে লবণ উৎপাদনকারী কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমরা কাঁচা লবণ এখন গোডাউনে মজুত করি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ট্রাক রাখার টার্মিনাল না থাকায় বিপত্তি তৈরি হয়েছে। রাতে কক্সবাজারের পেকুয়া, মগনামা, মহেশখালী থেকে লবণ নিয়ে ৩০-৪০টি ট্রাক আসে। ট্রাকগুলো আনলোড করা পর্যন্ত অবস্থানের কোনো জায়গা থাকে না। যে কারণে বিপত্তি তৈরি হয়েছে।’
এদিকে ট্রাকে কাঁচা ও ভেজা লবণ পরিবহনের সময় শুরু থেকেই পলিথিন ব্যবহারের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ট্রাকে পর্যাপ্ত পলিথিন ব্যবহার না করার কারণে সড়কে পানি পড়ছে। দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষ নিজে সচেতন না হলে তো আইন প্রয়োগ করে মানুষকে সচেতন করা যাবে না। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মহাসড়কগুলো তৈরি করা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে জাইকার অর্থায়নে ছয় লেনের সেতু হয়েছে। ইন্দ্রপুল সেতুটি এর মধ্যে অন্যতম।’
তিনি বলেন, ‘লবণপানি বিটুমিন সড়কের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এতে সড়কের যে বাইন্ডিং, সেটি নষ্ট হয়ে যায়। আয়ুষ্কাল কমে যায়। দ্রুত সড়কে গর্ত তৈরি করে। আবার লবণপানিতে ভেজা বিটুমিন সড়ক খুবই পিচ্ছিল হয়। এতে দুর্ঘটনাপ্রবণতা বাড়ে। শুধু লবণপানির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণহানিও হয়।’
সড়ক বিভাগের এ প্রকৌশলী বলেন, ‘আগেও লবণের পানি যাতে সড়কে না পড়ে সে ধরনের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লবণ পরিবহন করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু মিল মালিক কিংবা লবণ বিক্রেতারা বিষয়টিতে কর্ণপাত করছেন না। আমরা এখন হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেবো।’
পটিয়া ক্রসিং হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জসিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘লবণপানির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি ক্রমেই দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠছে। লবণপানির পিচ্ছিলতার কারণে বেশিরভাগ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সম্প্রতি ইন্দ্রপুল অংশ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যানবাহনের বিভিন্ন অনিয়মের জন্য নিয়মিত মামলা দেই। এখন থেকে লবণ পরিবহনের সময় সড়কে পানি পড়া ট্রাকগুলো মামলার আওতায় আনা হবে। ইন্দ্রপুলে যাতে ভেজা লবণভর্তি ট্রাক মহাসড়কের ওপর দাঁড়াতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবো।’
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইন্দ্রপুল অংশে বাইপাস হওয়ার আগে পৌরসভার পক্ষ থেকে একটি ট্রাক টার্মিনাল করা হচ্ছিল। কিন্তু পৌরসভার পক্ষ থেকে ওই টার্মিনাল পুরোপুরি সম্পন্ন করার আগেই বাইপাস সম্প্রসারণ হয়। পাশাপাশি ইন্দ্রপুলে লবণশিল্প রয়েছে। এখানে অনেক লবণ মিল। কক্সবাজার এলাকা থেকে আসা লবণবাহী ট্রাকগুলো থেকে পানি পড়ে মহাসড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার ইন্দ্রপুল অংশটিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে। ইতোমধ্যে আমরা লবণ মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। ট্রাক টার্মিনাল না থাকায় তাদেরও সমস্যা হচ্ছে। তারপরও এখানে আসা ট্রাকগুলো যাতে মহাসড়কে দাঁড়াতে না পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবো।