টানা ১০ বছর পরে কক্সবাজারে ফিরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ বিমান বন্দর থেকে যে গাড়ি যোগে পেকুয়া গেছেন তা বহুল আলোচিত প্রতিষ্ঠান এস আলমের মালিকানাধীন ছিল। আর সেই গাড়িতে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ উঠেছিলেন পেকুয়ার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী লায়ন মুজিবুর রহমানের অনুরোধে।
আর কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে এস আলমের প্রকল্পের দেখা-শোনা করার দায়িত্বে রয়েছেন লায়ন মুজিবুর রহমান। তিনি গত ৩/৪ বছরের বেশী সময় জুড়ে ব্যবহার করেন এই গাড়িটি। রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ঘরনার এবং কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি সহ অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত লায়ন মুজিবুর রহমানের বাড়ি পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ ভারতের বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে ১০ বছর পর কক্সবাজার আসলে মানুষের ঢল নামে বিমান বন্দরে আর সেখানে ছিলেন লায়ন মুজিবও। আর নানা কারণে তার ব্যবহৃত এসআলমের মালিকানাধীন গাড়িতে উঠে পেকুয়ায় ফিরেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সালাহউদ্দিন আহমেদের এই গাড়িতে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে যাচাইকালে এমন তথ্য মিলেছে।
গত ২৮ আগস্ট বুধবার বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে ঢাকা থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছান সালাহউদ্দিন আহমেদ। এরপর দলের নেতা-কর্মীদের গাড়িবহরের সঙ্গে পেকুয়ায় পৌঁছান তিনি। কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদের গাড়িবহর পেকুয়ায় পৌঁছার জন্য যে গাড়িটি ব্যবহার হয়েছে তার নম্বর চট্ট মেট্রো ঘ-১১-১৫৩৩। এটি মিতসুবিশির স্টেশন ওয়াগন ব্র্যান্ডের জিপ। তিনি সামনে সিটে বসে হাত নেড়ে আশপাশের লোকজনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কক্সবাজার থেকে চকরিয়ায় গিয়ে লাখো মানুষের জনসভা করেন এরপর যান নিজ জন্মভূমি পেকুয়ায়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিববহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক আইনুল হুদা জানিয়েছেন, চট্ট মেট্রো ঘ-১১-১৫৩৩ নম্বরের গাড়িটি এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন। এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্টের নামে এটি ২০১০ সালে নিবন্ধন করা। ঠিকানা লেখা আছে এস আলম ভবন, চট্টগ্রাম নগরের আছদগঞ্জ। এটি এস আলম গ্রুপের প্রধান কার্যালয়।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম)। দেশের ছয়টি ব্যাংকের মালিকানা ছিল এই গ্রুপের। দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর একে একে সামনে আসে এস আলম গ্রুপের দুর্নীতি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল ইসলাম (এস আলম) ও তাঁর সহযোগী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সালাহউদ্দিনের গাড়িটি ব্যবহার নিয়ে আলোচনা চলছে।
এ বিষয়ে সোমবার দুপুরে গুলশানের নিজ বাসভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অনিচ্ছাকৃত ভুলে এস আলমের গাড়ি ব্যবহার করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর পর আমার নিজ নির্বাচনী জেলায় সংবর্ধনায় অংশ নিয়েছিলাম। আমি বিমানবন্দর থেকে নেমে কোনো গাড়িতে করে যাবো, সেটা তো আমি ঠিক করতে পারি নাই। যারা সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ ঠিক করে দেন।
তিনি বলেন, বিমানবন্দরে নামার পর আমাদের নেতাকর্মীরা বলেছেন-এই গাড়িতে উঠেন। এখন সেই গাড়িটি কার তা তাৎক্ষণিক খোঁজ নেওয়ার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ছিলাম না। দীর্ঘ ১০ বছর পর নিজ জেলায় যাচ্ছি, তাই আবেগাপ্লুত ছিলাম। মনের মধ্যে বাসনা ছিল কখন মা-বাবার কবর জিয়ারত করব।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, পরে জানতে পারি এই গাড়িটি আমার এক ছোটভাইয়ের। যিনি এখানকার এস আলম গ্রুপের জমি দেখাশোনার কাজ করেন। তিনি কোম্পানির বিভিন্ন জমির বিষয়গুলো দেখে থাকেন। এই জন্য তাকে গাড়িটা ব্য বহারের জন্য দিয়েছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, আমি এস আলম কোম্পানির গাড়ি ব্যবহার করেছি- এ নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট হওয়ার পর দেশবাসীর মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তাই আমি যদি এজন্যহ অনিচ্ছাকৃতভাবে দেশবাসী ও কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ভিডিও পাওয়া গেছে তার একটিতে দেখা যায় গাড়িটিতে তার সাথে ছিলেন তার প্রেস সচিব এবং ভাতিজা ছফওয়ানুল করিম। তিনি সোমবার দুপুরে জানিয়েছেন, গাড়িটি পেকুয়ার ব্যবসায়ী লায়ন মুজিবুর রহমানের। বিমান বন্দরে সেদিন সালাহউদ্দিন আহমেদের আগমনকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষের জমায়েত হয়। মানুষের ভিড়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসা সালাহউদ্দিনের নিজস্ব গাড়িটি বিমান বন্দরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। এর মধ্যে নেতা-কর্মীদের সাথে বের হওয়ার সময় অনেক গাড়িতেই তাকে উঠতে বলা হয়। কিন্তু লায়ন মুজিবের গাড়িটি ছাদ খোলা হওয়ায় ওই গাড়িতেই তিনি উঠেন। মুজিব পেকুয়ার সন্তান এবং বিএনপি সমর্থক।
ছফুয়ানুল করিম বলেন, পরে খোঁজ নিয়ে গাড়িটি এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন জানা গেছে। লায়ন মুজিব এসআলমের মাতারবাড়ি প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লায়ন মুজিবকে এই গাড়ি ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। ওই গাড়িটি যোগে পেকুয়া আসলেও সালাহউদ্দিন আহমেদ পরের দিন নিজের গাড়িতে কক্সবাজার বিমান বন্দর হয়ে ঢাকা ফিরে যান। তিনি প্রশ্ন রাখেন আমরা কক্সবাজার, চকরিয়া, পেকুয়া থেকে প্রতিদিনই তো এস আলমের গাড়ি যোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাচ্ছি। ওখানে কোন সমস্যা নেই। তাহলে লায়ন মুজিবের অনুরোধে গাড়ি তো উঠা অপরাধ হলো কিভাবে?
এ ব্যাপারে লায়ন মুজিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি গাড়িটি এস আলমের মালিকানাধীন বলে স্বীকার করেন। তিনি জানান, মাতারবাড়ি প্রকল্প সহ কক্সবাজারের এস আলমের অন্যান্য ব্যবসায়িক কাজে গাড়ি ব্যবহার হয়ে থাকে। ওই দিন বিমান বন্দরে তিনি সহ কয়েকজন গাড়িটি নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সালাহ উদ্দিন আহমেদ বিমানবন্দরে পৌঁছার পর ওখানে তাঁর নিজস্ব গাড়ি প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে কোন গাড়িতে সালাহ উদ্দিন আহমেদ উঠবেন এটা নিয়ে এক-এক জন নেতা ভিন্ন ভিন্ন গাড়ির কথা বলেছিলেন। কিন্তু ছাদ খোলা সুবিধার কারণেই তার গাড়িটিতে উঠেন সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
প্রসঙ্গত সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ জুন কক্সবাজারে জেলা জাতিয়তাবাদী শ্রমিক দলের কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরা থেকে সালাহউদ্দিন নিখোঁজ হন। ৬২ দিন পর ওই বছরের ১১ মে ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ে স্থানীয় পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি দেশে ফিরেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসন থেকে দুবার (১৯৯৬ ও ২০০১) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী হাসিনা আহমেদও একবার (২০০৮) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১০ বছরের বেশি সময় পর গত ২৮ আগস্ট নিজ জেলা কক্সবাজারে আসেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। এসময় তাকে বিপুলভাবে সম্বর্ধিত করা হয়।