চলতি বছরই ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালুর পরিকল্পনা সরকারের। এরইমধ্যে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। সমুদ্রসৈকত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন।
রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, আগামী ১৫-২০ অক্টোবর দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইনে হবে ট্রায়াল রান। ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন ছুটবে কক্সবাজারে। আর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ বা ২৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, ট্রায়াল রানের জন্য চট্টগ্রামের পটিয়া স্টেশনে প্রস্তুত রাখা হয়েছে একটি ট্রেন। যেটিতে রয়েছে ৬টি বগি ও ২২০০ সিরিজের একটি ইঞ্জিন। কোরিয়া থেকে আনা এসব বগির একেকটিতে ৬০ জন করে যাত্রী বসতে পারবেন। বর্তমানে নগরের ষোলশহর থেকে দোহাজারি পর্যন্ত রেললাইনও পুরোদমে সংস্কার করা হচ্ছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট জানায়, পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২১৫ কোটি টাকা। সামগ্রিক প্রকল্পের প্রায় কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে।
এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। দুই পর্যায়ে এই প্রকল্প শেষ হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে ঘণ্টায় ১০০ বা ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করবে।
প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু হতে মিয়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৫২ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে।
এদিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে নির্মিত হয়েছে দেশের একমাত্র বিশ^মানের দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। যা এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান। এটি শুধুমাত্র স্টেশন নয়, পরিপূর্ণ একটি কমপ্লেক্স। রয়েছে তারকামানের হোটেল, লকার, শপিংমল, রেস্তোরাসহ বিশ^মানের সব সুযোগ-সুবিধা। স্টেশনের অবকাঠামো নির্মাণ এখন কাজ প্রায় শেষ। এখন শ্রমিকরা ব্যস্ত ঝিনুকের ফোয়ারায় রং লাগানো, বৃক্ষরোপন, চারপাশে সৌন্দর্যবর্ধন ও গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান চিহ্নিতকরণ।
আইকনিক স্টেশন ভবনের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার তাইজুল ইসলাম বলেন, শেষ মুহুর্তে আমরা খুবই আনন্দিত। আমাদের কাজগুলো এখন একদম শেষ পর্যায়ে। সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ যেমন রংয়ের করা, বৃক্ষরোপন, ঝিনুকের ফোয়ারায় রং করা এবং গাড়ি পার্কিংয়ের নির্ধারিত স্থান নিশ্চিতকরণের কাজগুলো করছি।
সরজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক স্টেশনটি দেখতে ভিড় করে পর্যটকরা, তুলছেন ছবিও। তারা বলছেন, যাতায়াত ভোগান্তি কমার পাশাপাশি সাশ্রয় হবে যাতায়াত খরচও।
আইকনিক স্টেশন দেখতে আসা পর্যটক সরওয়ার আলম বলেন, খুবই সুন্দর হয়েছে। বাংলাদেশে এত সুন্দর যে রেল স্টেশন হবে এটা চিন্তার বাইরে।
আরেক পর্যটক হুমায়ুন কবির বলেন, আইকনিক স্টেশনের মতো শৈল্পিক ভবন নির্মাণ দেশে বিরল। একটু ছুটির ফাঁকে এই আইকনিক স্টেশনটা দেখতে আসলাম। খুবই ভাল লাগছে এধরণের স্থাপনা দেখে।
উত্তরবঙ্গের থেকে আসা পর্যটক রহিমা খাতুন বলেন, কক্সবাজারে এত সুন্দর একটা স্টেশন হয়েছে এটা আমাদের মতো উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য ভাল হয়েছে। এখন যাতায়াত ভোগান্তি কমার পাশাপাশি সাশ্রয় হবে যাতায়াত খরচও।
হিলি থেকে আসা পর্যটক ইয়াকুব আলী বলেন, সরকারের এই ধরণের উন্নয়ন প্রকল্প সারাবিশে^ বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচয় ঘটাবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে কক্সবাজার আইনকনিক রেলস্টেশন পর্যবেক্ষণে যান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো: হুমায়ুন কবির। ঘন্টাব্যাপি কাজের অগ্রগতি দেখেন এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর নির্মিত রেলট্রাকে গ্যাংকার যোগে ৫০ কিলোমিটার রেললাইন পর্যবেক্ষণ করে দুপুরে চকরিয়াস্থ হারবাং স্টেশনে পৌছান। সেখানেও কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন।
এর আগে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন পর্যবেক্ষণ শেষে সাংবাদিকদের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো: হুমায়ুন কবির বলেন, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প এটা সারাদেশের জনগণের একটা স্বপ্নের প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দশনায় সম্পন্ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। আগামী ১৫ থেকে ২০ অক্টোবর দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইনে পরীক্ষামূলক ট্রায়াল রান হবে। আশা করছি, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বা ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
ড. মো: হুমায়ুন কবীর বলেন, এখন সরাসরি ঢাকা টু কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু হবে না। প্রথমে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। আশা করছি, নভেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রেলপথ মন্ত্রণালয় সচিব ড. মো: হুমায়ুন কবীর বলেন, চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু নির্মাণেও কোরিয়ার সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তির জন্য চূড়ান্ত খসড়া পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, আগামী মাসের মাঝামাঝি কিংবা খুব অল্প সময়ের মধ্যে চুক্তিটি সম্পাদন হয়ে যাবে। এরপরই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে যাবে।
ড. মো: হুমায়ুন কবীর আরও বলেন, চট্টগ্রামের কালুরঘাটের পুরনো যে সেতুটি রয়েছে তা দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচল শুরুর আগেই সংস্কার করে মজবুত করার কাজ চলছে। অক্টোবরের মধ্যে সেতুটির সংস্কার কাজও সম্পন্ন হবে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন হওয়ার পরের দিন থেকেই বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে না। আমরা হয় তো কিছুদিন সময় নেব। এরই মধ্যে হয় তো কালুরঘাটের পুরনো সেতুতে ট্রেন সীমাবদ্ধ গতিতে চলবে। দোহাজারী-কক্সবাজার নতুন যে রেললাইন এটাতে ১০০ বা ১২০ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন লোকোমোটিভ যাত্রী ট্রেন যাতে চলাচল করতে পারে যে উপযোগী করে নির্মাণ করা হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত কালুরঘাটে নতুন সেতু না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পুরনো সেতু অংশে শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ গতিতে ট্রেন চলবে। কিন্তু সেতুর পর থেকে ১০০ বা ১২০ কিলোমিটার গতি ট্রেন চলবে।
জনবল নিয়োগের ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রেলপথ মন্ত্রণালয় সচিব ড. মো: হুমায়ুন কবীর বলেন, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে রেল স্টেশনসহ সকল স্তরে ১২’শ জনবল প্রয়োজন। এই জনবলের জন্য এরই মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে অনুমোদনের জন্য। সেটাও দ্রুত সময়ের মধ্যে অনুমোদন হয়ে গেলে জনবলও পেয়ে যাব। আর এই সংক্রান্তে আগামী মাসে একটি সভা রয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে শেষ হয়েছে ৯টি স্টেশন নির্মাণ কাজ। এর মধ্যে রয়েছে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার। এসব স্টেশনে থাকছে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। দোহাজারী থেকে চকরিয়া এবং চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ ও আন্ডারপাসসহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
পাঠকের মতামত