তুষার তুহিন,টেকনাফ থেকে ফিরে ::
‘কক্সবাজার হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য মালয়েশিয়া। তারা জীবনমান উন্নয়নের জন্য সারাবছরই অবৈধভাবে কক্সবাজার জেলায় অনুপ্রবেশ করে থাকে। কাজের খোঁজেই গড়ে প্রায় প্রতিদিন শতাধিক রোহিঙ্গা জেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করে লোকালয়ে মিশে যাচ্ছে। আর যদি কোন ইস্যু তৈরি হয় তখন বানের পানির মত ভেসে আসে। যেমনটি চলছে গত মাস থেকেই। ’
মিয়ানমারে সহিংসতা পরবর্তী এদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে বাংলানিউজের কাছে এভাবেই নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেন উখিয়া-টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী।
সীমান্ত থেকে আধ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে বসবাসকারী সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী বাংলানিউজকে জানান, হ্নীলার ৩ নং ওয়ার্ডের ফুলের ডেইলের তার বসতবাড়ি থেকে মিয়ানমার সীমান্ত দেখা যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই তিনি দেখছেন মিয়ানমার থেকে এদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ। প্রায় প্রতিদিনই এই অনুপ্রবেশ চলে।
তিনি বলেন, ৯ নভেম্বর আমার বাড়ি থেকেই দেখা গেছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। রাতের নিস্তব্ধতায় শুনেছি গুলির শব্দ। জীবন বাঁচানোর জন্য রোহিঙ্গারা তো সেই রাতেই কিংবা এরপরদিন থেকে অনুপ্রবেশ করার কথা। কিন্তু রোহিঙ্গারা তো সেদিন আসেনি বরং ঘটনার এক সপ্তাহ পর এদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করেছে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, ১৯৭৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারের কোন ধনী রোহিঙ্গাকে এদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেখিনি, এরকম কিছু শুনতেও পাইনি। মূলত দুঃস্থ ও শ্রমিক শ্রেণির রোহিঙ্গারাই এদেশে অনুপ্রবেশ করে শ্রমবাজার দখল করছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন কক্সবাজার জেলার সুশীল সমাজের নেতারাও। সদ্য অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা মিলে।
এ বিষয়ে কুতুপালং আনরেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পে অবস্থানকারী মিয়ানমারের ঝিমংখালীর ছফুর আহমদ বাংলানিউজকে জানান, ১৬ নভেম্বর তিনি পরিবারের ২০ সদস্যসহ এদেশে এসেছেন। এর মধ্যে ৮ জন কুতুপালংয়ে রয়েছে। বাকি ১২ জন কক্সবাজার শহরে আগে থেকে বসবাসরত তার ছেলে মোহাম্মদ হোসেনের কাছে রয়েছে।
এসময় তার কাছে সহিংসতায় তার পরিবারের কোন প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ছফুর আহমদ জানান, মিয়ানমার মিলিটারি তার গ্রামের ওপর আক্রমণ করেনি। তবে তার গ্রাম থেকে অদূরের একটি বাজার আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া ওই গ্রামের আশেপাশে থাকা লোকজনের ধানের মজুদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এ কারণে ভয় পেয়ে সুযোগ বুঝে তারা পালিয়ে এসেছে।
৭ ডিসেম্বর মিয়ানমারের উদোম গ্রাম থেকে এদেশে অনুপ্রবেশকারী আব্দুল জব্বার বাংলানিউজকে জানান, তাদের গ্রামেও কোন সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। তবে আশেপাশের অনেক গ্রামে ঘটেছে।
মিয়ানমারে আব্দুল জব্বারের পেশা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, মিয়ানমারে শুধু দুটি কাজের ব্যবস্থা রয়েছে। ধান চাষ কিংবা পাহাড় থেকে কাঠ সংগ্রহ করা। এছাড়া মাছ ধরার কাজও করে অনেকে। মৌসুমে উৎপাদিত ধান দিয়েই সারাবছর চলতে হয়। মৌসুম ব্যতিত বছরের বাকিটা সময় বেকার বসে থাকতে হয়।
এদিকে ৮ ডিসেম্বর সকালে কুতুপালং আনরেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পের সামনে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় শুক্কুর নামের এক রোহিঙ্গার।
তিনি জানান, এদেশে এসেছেন প্রায় ১০ দিন হলো। কিন্তু এখনো কোন কাজের ব্যবস্থা করতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির জন্য তিনি এখনো কাজের সন্ধানে তেমন বের হননি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তিনি কাজে নেমে পড়বেন।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, মিলিটারি হামলাকে মুখ্য করে এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে গত একমাস ধরে প্রায় ৪০ হাজারের মত রোহিঙ্গা এদেশে অনুপ্রবেশ করছে। শুধু হামলা নয় মূলত রোহিঙ্গারা তাদের জীবনমান পরিবর্তন, কাজের খোঁজেই কক্সবাজার জেলায় আসছে।
২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বাংলানিউজকে জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমার ৬৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় নদীপথ ও দূর্গম পাহাড়ি পথ রয়েছে। এরপরও অনুপ্রবেশ ও চোরাকারবারী রোধে বিজিবি সবসময় কঠোর অবস্থানে থাকে। তারপরও বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। তবে সীমান্তে সড়ক ও কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ হয়ে গেলে অনুপ্রবেশ ও পাচার অনেকাংশে কমে যাবে।