হেলাল উদ্দিন সাগর::
কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার নামে চলছে চরম হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সদর হাসপাতালের দুর্গন্ধ, ময়লা - আবর্জনা, হাসপাতালের বিভিন্ন অনিয়ম, টেন্ডার বাণিজ্য, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর এম.আর'দের উপদ্রব, অব্যবস্থাপনা, রোগীদের হয়রানি, স্টাফ, নার্স, চিকিৎসক ও কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও দুর্নীতিতে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এখানকার সাধারণ মানুষ এমনটাই দাবি করেন জেলার সচেতন মহল। জরুরী বিভাগ, বহিঃবিভাগ, হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ ওয়ার্ড সহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মচারীরা অনৈতিক টাকা দাবি করে বলে জানা যায়। গতকাল রবিবার দুপুর ১২:৩০ টার সময় হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, এক লোক জরুরী বিভাগের টিকিট কাউন্টারে দায়িত্বরত লোকের সাথে কথা কাটাকাটি করছে। পরে জানা যায় লোকটির নাম নুরুল আবছার। রামু থেকে সোনিয়া নামের স্কুল পড়ুয়া ১৩ বছরের অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এসেছেন। নুরুল আবছার বলেন, 'আমার মেয়েটি স্কুলেই হঠাৎ করে ঢুলে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অসুস্থ, অজ্ঞান মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছি। তিনি বলেন, জরুরী বিভাগে কেউ আমার জ্ঞানহীন মেয়েটাকে ছুঁয়েও দেখেনি সরাসরি রেফার করা হয়েছে ওয়ার্ডে। টিকিট কাউন্টারে ভর্তি ফরম নেওয়ার সময় আমার কাছ থেকে ১০ টাকার জায়গায় ২০ টাকা নিয়েছে। ১০ টাকায় কেন ২০ টাকা দেব জানতে চাইলে ওরা আমার উপর ক্ষেপে যায়। নুরুল আবছার আরোও বলেন, তাদের সাথে তর্কবিতর্ক করেছি বলে ওরা আমার জ্ঞানহীন মেয়েকে রোগী বহন ভ্যান থেকে নিচের ফ্লোরে নামিয়ে দিতে চেয়েছিল। এমনকি জ্ঞানহীন মেয়েকে হাসপাতালের ওয়ার্ডে নেওয়ার সময় হাসপাতালের কর্মচারীদের শত অনুরোধ করেও কেউ এগিয়ে আসেনি বলে জানান নুরুল আবছার। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা নুরুল আবছার, শুক্কুর, জাহেদ, নুর নবী, ফাতেমা, খুরশিদা এরকম আরও অনেক রোগীর স্বজনদের একই অভিযোগ। জরুরী বিভাগ যেন রেফার বিভাগে রূপ নিয়েছে। জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশ রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে রেফার করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা যায়, যেসব রোগীদের জরুরী বিভাগে সেবা দেওয়া হয় সেসব রোগীদের মেডিসিন, সেলাই সুতা সহ প্রায় সবকিছু বাহির থেকে কিনতে হয়। এবং কর্তব্যরত চিকিৎসক ও কর্মচারীদের ৫০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত হাদিয়া দিতে হয় বলে জানা যায়। এই নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা। গত ১১ নভেম্বর শনিবার দুপুর ২ টায় হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে কথা হয় কর্তব্যরত এক মহিলা চিকিৎসকের সাথে। নাম বলতে অপারগ এই চিকিৎসক বলেন সংবাদ মাধ্যমকে কোন তথ্য না দেওয়ার জন্য তাকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। তিনি বলেন, 'আমার উপর নির্দেশ আছে রোগী দেখে ওয়ার্ডে রেফার করা'। এই ছাড়া কোন তথ্য দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় বলে জানান ওই চিকিৎসক। এদিকে প্রতিদিন সকালে বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সাথে হাসপাতালের বারান্দা সহ যত্রতত্র দেখা যায় বিভিন্ন ঔষুধ কোম্পানীর এম.আর'দের। রোগী প্রেসক্রিপশন নিয়ে ডাক্তারের রুম থেকে বের হওয়া মাত্র ঐ এম.আর'রা হামুগুড়ি দিয়ে একজন আরেকজনের উপর দিয়ে প্রেসক্রিপশন দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে অসুস্থ রোগী ও সাথে আসা স্বজনেরা খুব বিরক্ত বোধ করে। গতকাল বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা কহিনুর জাহান নামের এক মহিলার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, 'আমি সাড়ে তিন বছরের অসুস্থ ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। যখন কিনা ডাক্তারের রুম থেকে বের হলাম তখন দেখি আমার পাশে চার-পাঁচ জন ওষুধ কোম্পানিরর লোক প্রেসক্রিপশন দেখতে ব্যস্ত। যা আমাকে খুব বিব্রত ও হতাশ করেছে'। তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানির লোকগুলোর এই আচরণ সাধারণ মহিলাদের (যারা কর্তা ছাড়া হাসপাতালে আসেন) জন্য খুব অসৌজন্যমূলক। এবং এভাবে চলতে থাকলে মহিলারা ধীরে ধীরে হাসপাতাল আসা ছেড়ে দিবে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি। হাসপাতালে অবস্থানরত বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর এম.আর'দের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা কোম্পানীর নির্দেশমত কাজ করেন। আপনাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রোগী তথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোন দিষ্টার্ব হয় কিনা জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এম.আর বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সম্মতিক্রমে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে হাসপাতালে আসি। যদিও অনেক রোগী ও স্বজনেরা এতে বিরক্ত বোধ করে বলে স্বীকার করেন ঐ এম.আর। মেডিসিন বিশেষজ্ঞের এক গবেষণায় দেখা যায়, ডাক্তাররা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীকে খুশি করার জন্য রোগীর প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় মেডিসিন লিখে দিচ্ছে। বর্তমানে ডাক্তাররা রোগীর প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় ৭০% ওষুধ বেশি খাওয়াচ্ছে রোগীদের। এই যেন হাসপাতালে
অসুস্থ হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন!
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত স্ত্রীকে নিয়ে গত ১০ দিন ধরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ৫ম তলার মহিলা ও শিশু অপারেশন ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন টেকনাফের দলিলুর রহমান। তিনি বলেন, 'হাসপাতালে প্রথমে কোন সিটও পাওয়া যাইনি। নার্স ও আইয়াদের টাকা দিয়ে সিটের ব্যবস্থা করেছি। ঢিলেঢালা চিকিৎসা নিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। পরীক্ষা ও মেডিসিন সবকিছু বাহির থেকে করতে হয়'। হাসপাতালের খাবারেরও কোন মান নেই বলে জানান তিনি। মহেশখালী উপজেলার তরুণ ডাক্তার সুজাউদ্দিন এফ সোহান বলেন, 'গত কয়েক বছর স্বাস্থ্য খাতে হরেক রকম কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়লেও মৌলিক কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। সাংবিধানিকভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সরকার দেশের অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে না। এটা ঘটছে সরকারের সদিচ্ছা, ডাক্তারদের লোভনীয় মনোভাব, নার্স ও কর্মচারীদের উদাসীনতা, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সততার অভাবের কারণে'। অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের অবস্থা এখন অত্যন্ত শোচনীয়। ভবন আছে, বরাদ্দ আছে, যৎসামান্য চিকিৎসা সরঞ্জামও আছে; কিন্তু চিকিৎসকের পদ থাকলেও নিয়োগ নেই, নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের অধিকাংশই কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকেন না। দেশের দরিদ্র মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র প্রচুর অর্থ ব্যয় করে স্বাস্থ্যসেবার যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, কার্যকর মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণের অভাবে তা এক অর্থহীন উদ্যোগে পরিণত হতে চলেছে। চিকিৎসা নিতে আসা অনেক রোগীদের অভিযোগ কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ওষুধ নেই, অ্যাম্বুল্যান্স নেই, এক্স-রে মেশিন কিংবা অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নেই। যন্ত্রপাতি থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো অধিকাংশ সময় অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। আর ঠিক থাকলেও কমিশনের লোভে চিকিৎসকরা রোগীকে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে হরেক রকম দরকারি-অদরকারি টেস্ট করিয়ে আনতে বলেন বলে জানান একাধিক রোগীর স্বজনেরা। রায়হান কুতুবী নামের এক রোগীর স্বজন বলেন, কয়েকমাস আগে জমিজামা নিয়ে জের ধরে আমার বড়ভাইকে পায়ে আঘাত করে প্রতিপক্ষ। ভাইকে নিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ডাঃ এ হোসাইন সুমনের তত্ত্বাবধানে ভাইয়ের চিকিৎসা চলছিল। চিকিৎসা শেষের আগে ভাইকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং বলা হয় ডা. সুমনের চেম্বার 'ডিজিটাল হাসপাতালে' যোগাযোগ করতে। চেম্বারে গেলে আমাদের বিভিন্ন পরীক্ষা ও ডা. ফি সহ ৫০০০ টাকার বিল হাতে দেই। ভাইকে কেন হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছেন জানতে চাইলে ডা. সুমন বলেন হাসপাতালে ভাল চিকিৎসা হয়না তাই এখানে আসতে বলেছি।
সুশীল সমাজ মনে করেন কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিষ্ঠা-একাগ্রতা, সততা, দায়িত্ব-কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত না করা গেলে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে এ দেশের সাধারণ দরিদ্র অসহায় মানুষ। সেটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। কর্মক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও বিধিবিধান সংবলিত একটি নীতিমালা থাকা জরুরি বলে মনে করেন কক্সবাজারের বিশিষ্ট জনেরা।
হাসপাতালের বর্তমান পরিস্থিতি জানার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের (আর.এম.ও) ডা. মোঃ শাহীন আব্দুর রহমান চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পূর্বেকার তুলনায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালের বর্তমানে সেবার মান অনেক ভাল। এই সেবার মানকে আরও বেগতিক করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে'। তিনি আরও বলেন, যদি কোন কর্মচারী বা স্টাফদের দ্বারা রোগী হয়রানি বা অনৈতিক টাকা নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের চালিত এই হ-য-ব-র-ল অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহবান জানান কক্সবাজারবাসী।