আমিরুল ইসলাম মো. রাশেদ, কক্সবাজার
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেন হাফ-ডজন নেতা। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতে প্রার্থিতা নিয়ে প্রতিযোগিতা নেই।
কারণ আসনটিতে এ দু’টি দলেরই একক প্রার্থী রয়েছেন। মিয়ানমার লাগোয়া উখিয়া-টেকনাফ উপজেলা নিয়ে কক্সবাজার-৪ আসন। দু’টি উপজেলাই সারা বিশ্বে এখন পরিচিত নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির হিসেবে। এখানে রয়েছে একটি স্থলবন্দর। সবমিলিয়ে আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে এই আসন থেকে যে দলের প্রার্থী নির্বাচিত হন-দেখা যায় সেই দলই সরকার গঠন করে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে বরাবরই এমন হয়ে আসছে।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে আলাদা কদর থাকলেও মাদকের কারণে আছে সারাদেশে ব্যাপক বদনামও। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে এই অঞ্চলে ইয়াবা এবং আইসসহ আসে বিভিন্ন মাদক এবং স্বর্ণের চালান। এটি ‘মাদকের স্বর্গরাজ্য’ বলেই অনেকের কাছে পরিচিত। এমনকি অনেক জনপ্রতিনিধিও ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
তবে সাধারণ মানুষ চায় এসব বদনাম মুছে দিতে বিতর্কমুক্ত কেউ নির্বাচিত হোন এই আসনে।
সম্প্রতি উখিয়া-টেকনাফ আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি বাড়ছে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক হাফ ডজন মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতার তৎপরতা। বিএনপি এবং জামায়াতে একক প্রাথী হলেও তারাও সক্রিয় রয়েছেন এ আসনে।
১৯৮৬-১৯৮৮ সালে এই আসনে এমপি নির্বাচিত হন আ হ আ গফুর চৌধুরী। এরপর চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৮৮-১৯৯০ সালে এমপি নির্বাচিত হন রাজনীতিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আব্দুল গণি। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বর্তমানে তার পুত্র ব্যবসায়ী সাইফুদ্দিন খালেদও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনিও এবার নৌকা প্রতীকের মনোনয়নপ্রত্যাশী।
১৯৯১-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এখানে বিএনপির এমপি ছিলেন শাহজাহান চৌধুরী। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী। তার পুত্র টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব মোর্শেদ এবার নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী।২০০১-২০০৫ সালে এখানে এমপি ছিলেন বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী। তিনি এই আসন থেকে তিনবার এমপি নির্বাচিত হন।
আশির দশকে টেকনাফের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ছিলেন এজাহার মিয়া কোম্পানি। এজাহার মিয়ার রাজনীতির শুরু জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। পরবর্তী সময়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যান তিনি। ওই সময় জাতীয় পার্টির টিকেটে নির্বাচিত হন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও।
পরবর্তী সময়ে এজাহার মিয়ার দেখানো পথেই হাঁটা শুরু করেন তাঁর বড় ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। তিনি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বারবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন।
উল্লেখ্য ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে উখিয়া-টেকনাফ আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন বদি। নির্বাচনের কিছুদিন আগে সেই মনোনয়ন কেড়ে নেওয়া হয়। এতে বেঁকে বসেন তিনি। যোগ দেন আওয়ামী লীগে। এসেই নৌকা প্রতীকের জন্য শুরু করেন জোর লবিং। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনাফ সদরকে পৌরসভা ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৮ সালে বদি আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায় পৌরসসভার প্রশাসক নির্বাচিত হন। আর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য।
এর পর থেকেই এমপি আবদুর রহমান বদি হয়ে ওঠেন উখিয়া-টেকনাফের রাজনীতিতে অপ্রতিরোধ্য। একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন তিনি। টেকনাফ চলে তার কথায় । অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে তার ইচ্ছাতেই প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদকের মামলায় সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদিকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন না পেলেও তার স্ত্রী শাহিন আক্তার নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। শাহীন আক্তার নির্বাচিত হলেও এখনও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামে আবদুর রহমান বদিই অংশগ্রহণ করে থাকেন। তিনি আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন কি না তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।
অন্যদিকে আসনটিতে বদির শ্যালক উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং রাজা পাললং ইউনিয়ন পরিষদের তিনবারের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আগামীতে আবদুর রহমান বদির শ্যালক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী, নাকি তার স্ত্রী বর্তমান সংসদ সদস্য শাহিন আক্তার অথবা তিনি নিজেই আবার মনোনয়ন পাবেন কি না তা নিয়ে চলছে আলোচনার ঝড়।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতা মাঠে বদির বিপক্ষে তৎপরতা চালাচ্ছেন। তার মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি রাজা শাহ আলমের ৬ জনের একটি গ্রুপ এবং কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সভাপতি সোহেল আহমদ বাহাদুরের তৎপরতা সবার নজর কাড়ছে।
এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন বদির চাচা শ্বশুর উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী, তার স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী নিগার সুলতানা, বদির আরেক চাচা শ্বশুর বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফর আলম চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাজা শাহ আলম, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কবি আদিল উদ্দিন চৌধুরী, টেকনাফ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল বশর, সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর পুত্র এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব মোর্শেদ, সাবেক এমপি আবদুল গণির পুত্র ব্যবসায়ী এবং উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুদ্দিন খালেদ। তারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে জোর লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন বলে শোনা যায়।
অন্যদিকে বিএনপিতে কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক তিনবারের সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী এলাকার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। বিএনপি আন্দোলন ও নির্বাচন-দুটিরই প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে শাহজাহান চৌধুরীর নামই শোনা যায়। এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে। এই আসন থেকে কক্সবাজার জেলা জামায়াতের আমির ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ইতিমধ্যেই জানান দিয়েছেন। তবে এখানে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম তেমন একটা চোখে পড়ে না।
ইতিমধ্যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা প্রার্থী হতে চান তাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি থেকে ডজনখানেক নেতা নির্বাচনি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
দুটি উপজেলা এবং একটি পৌরসভাসহ ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৪ অর্থাৎ সংসদীয় আসন ২৯৭। মোট ভোটারের সংখ্যা তিন লাখের অধিক।
এ কারণে এই আসনের ভোটারদের মধ্যে একটি বিশ্বাস কাজ করে যে, এটি হচ্ছে সরকার গঠনের জন্য লক্ষ্মী আসন। ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে বিএনপি দলীয় প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী নির্বাচিত হন। আর এ দুবারই বিএনপি ক্ষমতায় আসীন হয়।
অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এবং ২০০৯ সালে এবং ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুর রহমান বদি এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে এমপি নির্বাচিত হন এমপি বদির সহধর্মিণী শাহিন আক্তার বদি। উল্লিখিত চারবারই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হয়।
উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ-৭১-এর টেকনাফ উপজেলা সভাপতি সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন আমরা সবাই তার জন্য কাজ করব।
তবে উখিয়া-টেকনাফকে ইয়াবা তথা মাদকমুক্ত করে এলাকার কলঙ্ক মোছার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করে তিনিসহ তার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কবি আদিল চৌধুরী এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি রাজা শাহ আলমও মনোনয়ন চাইবেন বরে জানান।