কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ফুলে উঠছে দেশের একমাত্র কৃত্রিম জলাধার রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদ। বৃষ্টিপাতের প্রভাবে হ্রদের পানির উচ্চতা বাড়ায় কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছে কর্তৃপক্ষ। কাপ্তাই হ্রদে পানিস্বল্পতার কারণে শুকনো মৌসুম থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের দুটি ইউনিট চালু ছিল। বর্তমানে পাঁচটি ইউনিটই চালু রেখেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানিয়েছে, কাপ্তাই হ্রদে পানিপ্রবাহ বাড়ায় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকলে আরো বাড়ানো হতে পারে উৎপাদন। ৩ আগস্টের আগে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিটে গড়ে ৬০-৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও এখন দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৫ মেগাওয়াট। কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চেয়ে পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন খরচ অনেক কম। যে কারণে কেন্দ্রটি উৎপাদন খরচ সাশ্রয়ের দিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। তবে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টারের (এনএলডিসি) চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হ্রাস-বৃদ্ধি করে কর্তৃপক্ষ।
কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (কন্ট্রোল রুম) সূত্রে জানা গেছে, কাপ্তাই হ্রদের পানি পরিমাপের রুল কার্ড (সময়সূচিভিত্তিক পানি ওঠানামার মাপ) অনুযায়ী, গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৮৩ দশমিক ৫৮ মিনস সি লেভেল (এমএসএল) পানি রয়েছে। যদিও স্বাভাবিকভাবে পানি থাকার কথা ৯০ দশমিক ৬০ এমএসএল। রুল কার্ডের হিসাবেই বর্তমানে ৭ এমএসএল পানি কম রয়েছে। তবে বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকলে পানির কাঙ্ক্ষিত লেভেল পূর্ণ হতে পারে। বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পাঁচটি ইউনিটে গড়ে ১৩৫ মেগাওয়াট উৎপাদন করা যাচ্ছে। গতকালের হিসাবমতে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটে মোট ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে সব ইউনিট মিলিয়ে উৎপাদন হচ্ছে ১৩৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১ নম্বর ইউনিটে ৩৩ মেগাওয়াট, ২ নম্বর ইউনিটে ৩২, ৩ নম্বর ইউনিটে ২৬ এবং ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটে ২২ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্বরত এক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, কয়েকদিন আগেও কেন্দ্রের দুটি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল। বর্তমানে পাঁচটি ইউনিটই চালু করা হয়েছে। তবে উৎপাদন বাড়ানো-কমানো নির্ভর করে কাপ্তাই হ্রদের পানির পরিমাপ ও এনএলডিসির চাহিদার ভিত্তিতে। এখন হ্রদে পানির প্রবাহ থাকায় উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের চাহিদাও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বা প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৩ টাকা ৪৬ পয়সা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের খরচ ৯ টাকা ১৭ ও ফার্নেস অয়েলের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ২২ টাকা ১০ পয়সা। অন্যদিকে রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে অবস্থিত দেশের একমাত্র কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ মাত্র ৩০-৪০ পয়সা (সব ইউনিট সচল রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়া সাপেক্ষে)। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাশ্রয়ী ভূমিকা রাখছে কেন্দ্রটি।
এ প্রসঙ্গে জানতে কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী এটিএম আব্দুজ্জাহেরের সেলফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দায়িত্বশীল এক প্রকৌশলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে পরিমাণ উৎপাদন ব্যয় হয়, তা পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন ব্যয় অনেক সাশ্রয়ী। যে কারণে এ কেন্দ্রে উৎপাদন বাড়ানো গেলে ব্যয় কম হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। তবে আমাদের কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি নির্ধারিত করে কিংবা চাহিদা দেয় এনএলডিসি। এ চাহিদার ওপর ভিত্তি করে কাপ্তাই হ্রদের পানির পরিমাণ অনুযায়ী উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো যায়। গত বৃহস্পতিবারের আগে কেন্দ্রের দুটি ইউনিটে গড়ে ৬০-৬৫ মেগাওয়াট উৎপাদন করা গেলেও বর্তমানে পাঁচটি ইউনিটে গড়ে ১৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। অফিশিয়ালি ২৩০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার এ কেন্দ্রটিতে পূর্ণ উৎপাদনে নিয়ে গেলে ২৪২ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।’
এদিকে রাঙ্গামাটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়র পর্যবেক্ষক ক্য চিং নু মারমা বণিক বার্তাকে জানান, গত বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় রাঙ্গামাটিতে ৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুক্রবার ৭৭ দশমিক ২ ও শনিবার ১৪৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৬১ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে শনিবার।
উল্লেখ্য, ষাটের দশকে পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেয়ার কারণে গড়ে ওঠে বিস্তীর্ণ কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। ১৯৬২ সালে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেয়া অংশে চালু করা হয় দেশের একমাত্র পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কৃত্রিমভাবে হ্রদের পানি সংরক্ষণের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। শুরুর দিকে কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৮০ মেগাওয়াট। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে স্থাপনাটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে মোট ২৪২ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে। এ উৎপাদনের পুরো বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে। কেন্দ্রটির কাপ্তাই হ্রদে বাঁধ দেয়া অংশে ১২ দশমিক ২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১১ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থের ১৬টি জলকপাট বা স্লুইসগেট রয়েছে। এগুলো দিয়ে একসঙ্গে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক পানি নির্গমন করতে পারে। হ্রদে ১০৯ এমএসএলের অধিক পানি পূর্ণ হলে জলকপাট দিয়ে পানি নির্গমন করা হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তিন বছর ধরে কম বৃষ্টিপাত ও পানির উৎস কমে যাওয়ায় হ্রদের পানি আশানুরূপ বাড়ছে না।
পাঠকের মতামত