কালেরকন্ঠ::
কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশি হয়রানি সীমা ছাড়িয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাত বিরাতে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে যায় নীরিহ লোকজনকে। ‘ইয়াবা কারবারি’ অভিযোগ তুলে অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে টাকা আদায় করা হয়। টাকা না দিলে ইয়াবা মামলায় চালান করা হয় আদালতে। পুলিশ ইয়াবা কারবারিদের সাথে একাট্টা হয়ে ইয়াবা বিরোধীদেরই শায়েস্তা করছে। যতইনা ইয়াবা কারাবারিদের ধরার জন্য অভিযান চালানো হয় তার চেয়েও বেশি অভিযান চলে ইয়াবা বিরোধীদের ঘরে।
ইয়াবা কারবারের সোচ্চার ব্যক্তিদের ধরে আনার পর টাকা না দিলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এরকম কমপক্ষে ২৫টি হয়রানি মামলা দায়েরের অভিযোগ উঠেছে কেবল একজন অফিসারের বিরুদ্ধে। টেকনাফ থানা পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমনসব গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।
দেশের ইয়াবা পাচারের ‘গেইটওয়ে’ হিসাবে পরিচিত টেকনাফ সীমান্তে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে পুলিশি হয়রানি। এরকম ঘটনায় গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, সীমান্তের তৃণমূলের ‘খাঁটি’ আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর পুলিশি হয়রানি মাত্রা ছাড়িয়েছে। অপরদিকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে ‘হাইব্রিড’ আওয়ামী লীগ কর্মীরা।
প্রসঙ্গত, টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ নানা কোন্দলে দ্বিধাবিভক্ত। সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ও নুরুল বশরের নেতৃত্বে দলের নেতা-কর্মীরা ‘খাঁটি’ আওয়ামী লীগ এবং এমপি আবদুর রহমান বদির নেতৃত্বে থাকা অংশটি ‘হাইব্রিড’ আওয়ামী লীগ হিসাবে এলাকায় পরিচিত।
টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ফাঁড়ির পুলিশ বুধবার বিকালে হাফেজ আহমদ নামের একজন ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীকে ইয়াবা কারবারির তালিকাভুক্ত সদস্য অভিযোগে ধরে নিয়ে যায়। এই ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ী টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মুফিজুল ইসলাম এই ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ী এবং তৃণমূলের একজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে ধরে নেওয়ার পর নগদ ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে ধার-হাওলাত করে বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশকে নগদ দেড় লাখ টাকা দিয়ে তিনি মুক্তি পান।
মাছ ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা হাফেজ জানান, ‘পুলিশ আমাকে অযথা হয়রানির মাধ্যমে আমার নিকট থেকে দেড় লাখ টাকা আদায় করেছে। আবার বিক্রি করতে নেওয়ার সময় পথিমধ্যে পড়ে থাকা আামার দেড় মণ চিংড়ি মাছও পঁচে গেছে। যেন আমি এদিকও হারিয়েছি-ওদিকও হারিয়েছি। ’
এ বিষয়ে ফাঁড়ির দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মুফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সন্দেহজনকভাবে আওয়ামী লীগ নেতা হাফেজকে এনেছিলাম এটা সত্যি। তবে তার নিকট থেকে কোন টাকা নেইনি। ’
তৃণমূলের একজন ‘খাঁটি’ আওয়ামী লীগ কর্মীকে অহেতুক তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি হিসাবে ধরে দেড় লাখ টাকা আদায়ের ঘটনায় বুধবার রাতেই ফেসবুক ষ্ট্যাটাস দেন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর। নুরুল বশর তাতে উল্লেখ করেন, ‘আমার জানামতে তার (হাফেজ আহমদ) কোন ধরনের মামলা-মোকদ্দমা বা অভিযোগ পর্যন্ত নেই। আইসি (ফাঁড়ির ইনচার্জ) সাহেব উপরের আদেশে দেড় লাখ টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেন। ’ এই স্ট্যাটাসটি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে।
তিনি স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন-টেকনাফ থানা পুলিশ আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী নিধনে কৌশলে কারও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। পুলিশের এরকম লাগাতার অপকর্মের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক স্ট্যাটাস ব্যবহারকারি এ ঘটনার নিন্দা জানান। পুলিশের উখিয়া-টেকনাফ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিঃ চাইলাউ মারমা এ প্রসঙ্গে জানান-হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির এ ঘটনাটি ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
এদিকে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের পুলিশ সুপারের কাছে টেকনাফ পুলিশের দুইজন উপ-পরিদর্শকের বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও গ্রেপ্তার বাণিজ্যের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, টেকনাফ থানার উপ-পরিদর্শক মো. একরামুজ্জামান গত ১৯ জুন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ফরিদ আহমদ রমজানকে ঘর থেকে থানায় ধরে নিয়ে যান। পরে তাকে ইয়াবা মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে নগদ এক লাখ টাকা নিয়ে ছেড়ে দেন।
পুলিশের এই উপ-পরিদর্শক গত ২২ জুন পবিত্র শবেকদরের রাতে টেকনাফের গুদারবিলের দু'টি ঘরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে। যাতে গণরোষেরও সৃষ্টি হয়। গত ৫ জুলাই হোয়াইক্যং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি চিংড়ি ব্যবসায়ী শাহ আলমকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে ৬০ হাজার টাকা আদায় করেন। থানায় ধরে আনার পর টাকা না দেওয়ায় কমপক্ষে ২৫ জন নিরীহ ব্যক্তির বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়েরেরও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
এসব বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় উপ পরিদর্শক মো. একরামুজ্জামানের সাথে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘ঘটনা যা হবার হয়ে গেছে। আসলে এগুলো কোন ঘটনাই না। তবে আমি অনুমতি পেলে আপনার (প্রতিবেদক) সাথে যোগাযোগ রক্ষা করব। ’
থানার অপর উপ-পরিদর্শক আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ১৭ জুন টেকনাফের হ্নীলা স্টেশনের টিনের দোকানি আবু তাহেরকে ধরে নিয়ে ইয়াবা মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করেন। গত ২০ জুন তারিখে তিনি টেকনাফের পূর্ব পানখালী গ্রামের এনজিও কর্মী মোহাম্মদ কামালকে ধরে তিন লাখ টাকা আদায় করেন।
বৃহস্পতিবার বিকালে পুলিশের উপ-পরিদর্শক আবদুর রহিমের মোবাইলটি বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। টেকনাফ থানার ওসি মো. মাঈনুদ্দিন খান জানান, থানার অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি টেকনাফ থানা পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এসব তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ’ পুলিশ সুপার জানান, অভিযোগ প্রমাণিত হলে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর তার লিখিত অভিযোগে আরো উল্লেখ করেন, টেকনাফ থানার এসব কর্মকর্তারা বিভিন্ন অপকর্ম ছাড়াও সীমান্তের ইয়াবা কারবারিদের সাথেই সখ্য গড়ে টাকা আদায় করছেন। উপরন্তু ইয়াবাকারবারিদের পরামর্শে পুলিশ ইয়াবার বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়ামী লীগ কর্মীদের বাছাই করে অত্যাচার-নির্যাতন সহ গণহারে হয়রানি করছে। এতে করে দলীয় রাজনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলে তাতে উল্লেখ করা হয়।
টেকনাফ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন-টেকনাফ থানা পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা ‘ধরাকে সরা’ মনে করেই কুকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমার একজন ঘনিষ্ট আত্মীয়কে ধরে উপ-পরিদর্শক আবদুর রহিম বেদম মারধরের পর ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। আমি খবর পাবার পর থানার ওসিকে যখন এ বিষয়ে বলি তখন উপ-পরিদর্শক রহিম আরো ক্ষিপ্ত হয়ে আমার আত্মীয়কে হুমকি দিতে থাকেন।
সুত্র: কালেরকন্ঠ