গিবত সমাজের বহুল প্রচলিত পাপ। এই পাপ নীরব ঘাতকের মতো। মনের অজান্তেই এটা ব্যক্তির ভালো কাজ বিনষ্ট করে দেয়। এটি ব্যভিচার ও মরা মানুষের পচা গোশত খাওয়ার চেয়েও নিকৃষ্টতম কাজ।
সমাজের বেশির ভাগ মানুষ এই পাপে নিমজ্জিত। গিবত শব্দের অর্থ পরনিন্দা করা, দোষচর্চা করা, কুৎসা রটনা, পেছনে সমালোচনা করা, কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরা।
গিবতের পরিচয় সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা কি জানো গিবত কী? সাহাবিরা বলেন, এ ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সর্বাধিক অবগত। তখন নবী (সা.) বলেন, (গিবত হচ্ছে) তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে এমন কিছু বলা, যা সে অপছন্দ করে।
জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আমি যা বলছি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলে আপনার অভিমত কী?’ তিনি বলেন, তুমি তার (দোষ-ত্রুটি) সম্পর্কে যা বলছ, সেটা যদি তার মধ্যে থাকে, তাহলে তুমি তার গিবত করলে। আর যদি সেই (ত্রুটি) তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৭৪; তিরমিজি, হাদিস : ১৯৩৪)
গিবতের মূল মাধ্যম চারটি :
১. জিহ্বার গিবত : গিবতের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো জিহ্বা। আলাপচারিতা, কথাবার্তা ও বক্তৃতায় জবানের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি গিবত হয়।
২. অন্তরের গিবত : কুধারণা করা, হিংসা, অহংকার এবং কেউ গিবত করলে সেটা অন্তর দিয়ে মেনে নেওয়া বা তা সমর্থন করার মাধ্যমে অন্তরের গিবত হয়।
৩. ইশারা-ইঙ্গিতের গিবত : কখনো কখনো চোখ, হাত ও মাথার ইশারার মাধ্যমেও গিবত হয়ে থাকে।
৪. লেখার মাধ্যমে গিবত : মানুষের মনের ভাব ও মতামত প্রকাশের একটি বড় মাধ্যম হলো লেখা। তাই লেখার মাধ্যমেও গিবত হতে পারে। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘লেখার মাধ্যমেও গিবত হয়ে থাকে।
কেননা কলম দুই ভাষার একটি। ’ (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/১৪৫)
গিবতের বিধান
গীবত করার বিধান দুই ভাগে বিভক্ত। (১) গিবত করার বিধান। (২) গিবত শোনার বিধান।
১. গিবত করার বিধান : গিবত একটি জঘন্য পাপ। গিবতের মাধ্যমে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
২. গিবত শোনার বিধান : গিবত করা যেমন মহাপাপ, তেমনি খুশি মনে পরনিন্দা শোনাও পাপ। মহান আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, ‘তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন যেন তা উপেক্ষা করে। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫৫)
ওলামায়ে কেরাম বলেন, গিবতকারী ও গিবত শ্রবণকারী উভয়ই সমান পাপী। (মাওসুআতুল আখলাক : ২/৪০৭)
গিবতের ভয়াবহতা
গিবত করা কবিরা গুনাহ : অন্যান্য পাপের তুলনায় গিবতের প্রভাব ও পরিণাম বেশি ভয়ংকর। রাসুলুল্লাহ (সা.) গিবতের ভয়াবহতা বুঝাতে যে উপমা দিয়েছেন, অন্য কোনো মহাপাপের ব্যাপারে এত শক্তভাবে বলেননি। যেমন আয়েশা (রা.) বলেছেন, আমি একবার ছাফিয়া [রাসুল (সা.)-এর স্ত্রী]-এর দিকে ইশারা করে বললাম, সে তো বেঁটে নারী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি তো তার গিবত করে ফেললে। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ২৫৭০৮)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, তুমি এমন একটি কথা বলেছ, যদি তা সমুদ্রে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তবে সমুদ্রের পানির রং পাল্টে যাবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫০২)
মানুষের গোশত খাওয়ার চেয়েও নিকৃষ্ট পাপ
মানুষের গোশত খাওয়া হারাম। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ গিবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ করো না এবং পরস্পরের পেছনে গিবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? আসলে তোমরা সেটি অপছন্দ করে থাক। ’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)
ব্যভিচার ও সুদের চেয়েও নিকৃষ্ট পাপ
সমাজে প্রচলিত পাপগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় জঘন্য পাপ হলো ব্যভিচার ও সুদ। আর ব্যভিচার ও সুদের চেয়েও ক্ষতিকর ও নিকৃষ্ট পাপ হলো গিবত। বারা ইবনে আজেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, গিবতের ৭২টি দরজা আছে। তন্মধ্যে নিকটবর্তী দরজা হলো কোনো পুরুষ কর্তৃক তার মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। আর সবচেয়ে বড় সুদ হলো অন্য ভাইয়ের সম্মানহানি করা (অর্থাৎ গিবত করা)। (সহিহুল জামে, হাদিস : ৩৫৩৭)
গিবতকারী কবরে শাস্তি পাবে
মৃত্যুর পর থেকেই গিবতকারীর পরকালীন শাস্তি শুরু হয়ে যায়। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) একদা দুটি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। এ সময় তিনি বলেন, এদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে কোনো গুরুতর অপরাধের জন্য তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। তাদের একজন পেশাব থেকে সতর্ক থাকত না। আর অন্যজন চোগলখুরি করে বেড়াত। (বুখারি, হাদিস : ২১৮)
অন্যত্র রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তাদের একজন মানুষের গিবত করত। আর অপরজন পেশাবের (ছিটার) ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত না। (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৭৩৫)
কিয়ামতের দিন অন্যের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে চাপে
কিয়ামতের দিন গিবতের বদলা নেওয়া হবে। যার গিবত করা হয়েছে তার পাপের বোঝা গিবতকারীর কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা কি বলতে পার, নিঃস্ব কে? সাহাবিরা বললেন, ‘আমাদের মধ্যে যার টাকা-কড়ি ও আসবাবপত্র নেই, সেই তো নিঃস্ব। ’ তখন তিনি বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই প্রকৃত নিঃস্ব, যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম ও জাকাতের আমল নিয়ে উপস্থিত হবে; অথচ সে এই অবস্থায় আসবে যে, একে গালি দিয়েছে, একে অপবাদ দিয়েছে, এর সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, একে হত্যা করেছে ও একে মেরেছে। এরপর একে তার নেক আমল থেকে দেওয়া হবে, ওকে নেক আমল থেকে দেওয়া হবে। এরপর তার কাছে (পাওনাদারের) প্রাপ্য তার নেক আমল থেকে পূরণ করা না গেলে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৪৭৩)
জান্নাতে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত
গিবতকারী মুসলিম যদি গিবত থেকে তাওবা না করে মারা যায়, তবে সে প্রথম সুযোগে জান্নাতে যেতে পারবে না; বরং তাকে গিবতের শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রথমে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে অপমান করার উদ্দেশ্যে তাকে দোষারোপ করবে, মহান আল্লাহ তাকে জাহান্নামের সেতুর ওপর আটক করবেন, যতক্ষণ না তার কৃতকর্মের ক্ষতিপূরণ হয়। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৮৩)