কক্সবাজার ইসলামিয়া মহিলা কামিল (মাস্টার্স) মাদরাসা কেন্দ্রে দাখিল পরীক্ষায় মারাত্মক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠেছে। বিধি বহির্ভুতভাবে কিছু পরীক্ষার্থীকে অতিরিক্ত সময় প্রদান, আর কিছু ছাত্রের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে ক্ষুব্ধ শিক্ষক ও অভিভাবকরা। ফলাফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে অনিয়মের শিকার পরীক্ষার্থীরা। ঘটনার সুষ্ঠু প্রতিকার চান তারা।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে দাখিল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। মাদরাসার পূর্ব ভবনের তৃতীয় তলার ৩০৩ নং কক্ষে পরীক্ষা দিচ্ছেন ৩২ জন। সেগুলোর ক্রমিক নাম্বার হলো, ২৪৫৪৬৭, ২৪৫৩৪২, ২৪৫৪৬৯, ২৪৫৩৪৪, ২৪৫৪৭১, ২৪৫৩৪৬, ২৪৫৪৭৩, ২৪৫৩৪১, ২৪৫৪৬৮, ২৪৫৩৪৩, ২৪৫৪৭০, ২৪৫৩৪৫, ২৪৫৪৭২, ২৪৫৩৪৭, ৪২৬৩১৮, ২৪৫৩৪৯, ৪২৬৩২০, ২৪৫৩৫১, ৪২৬৩২২, ২৪৫৩৫৩, ৪২৬৩২৪, ২৪৫৩৫৫, ৪২৬৩২৬, ২৪৫৩৪৮, ৪২৬৩১৯, ২৪৫৩৫০, ৪২৬৩২১, ২৪৫৩৫২, ২৪৫৩৫৪, ৪২৬৩২৫, ২৪৫৩৫৬।
এখানে কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল (মাস্টার্স) মাদরাসার সাধারণ বিভাগের ৭ জন (২৪৫৪৬৭ থেকে ২৪৫৪৬৩) এবং বিজ্ঞান বিভাগের ৯ জন (৪২৬৩১৮ থেকে ৪২৬৩২৬)সহ মোট ১৬ জন পরীক্ষার্থী। বাকি ১৬ জন মাদরাসা-এ তৈয়বিয়া তাহেরিয়া সুন্নিয়ার।
রবিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ছিল হাদিস শরীফ। এই পরীক্ষায় নির্ধারিত সময়ের বাইরে অতিরিক্ত সময় দিয়ে কিছু ছাত্র থেকে পরীক্ষা নেওয়া হয়। যে কারণে ‘ভুল উত্তরপত্র’ শুদ্ধ করার সুযোগ পান তারা। আর কিছু পরীক্ষার্থী বিষয়টি জানেও না। এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির পাশাপাশির শিক্ষকদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ করা হচ্ছে।
সাধারণত, ওএমআর ফরমে ‘বৃত্ত ভরাট’ করেই ‘এমসিকিউ’ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়। কিন্তু হাদীস শরীফ পরীক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা ছিলো, সঠিক উত্তরটি খাতায় লিখতে হবে। ওএমআর ফরমে ‘বৃত্ত ভরাট’ করলে হবে না।
এ ক্ষেত্রে অভিযোগ হলো, ৩০৩ নং কক্ষের পরীক্ষার্থীদের ভুল তথ্য দিয়েছেন দায়িত্বরত পর্যবেক্ষক। এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তরে ‘বৃত্ত ভরাট’ করতে বলায় পরীক্ষার্থীরা সেভাবে লিখে উত্তরপত্র জমা দেন।
পরে মাদরাসা-এ তৈয়বিয়া তাহেরিয়া সুন্নিয়ার পরীক্ষার্থীদের ডেকে অতিরিক্ত সময় দিয়ে উত্তরপত্র সঠিক করে নেওয়া হয়। এ সময় কেন্দ্র সচিব মোহাম্মদ মাহমুদুল করিম ফারুকী, হল সুপার মনসুর আলম আজাদ ও হল পর্যবেক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
অভিযোগ হলো, একই হলের কিছু পরীক্ষার্থীকে সুযোগ দেওয়া হলেও হাশেমিয়ার কাউকে জানানো হয় নি। যে কারণে ১৫ নাম্বার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা। এসব পরীক্ষার্থীর নিশ্চিত ফল বিপর্যয় হবে।
হাশেমিয়া মাদরাসার বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক অভিযোগ করেন, নির্ধারিত সময়ের পরে তৈয়বিয়া মাদরাসার পরীক্ষার্থীদের থেকে আবার পরীক্ষা নেওয়া হয়। তারা এমসিকিউ উত্তরপত্র খাতায় সঠিকভাবে লিখেছেন। অথচ এই খবর হাশেমিয়ার ১৬ জন পরীক্ষার্থীর কাউকে জানানো হয় নি। সন্ধ্যায় অন্যান্য পরীক্ষার্থী মারফত জেনেছেন তারা।
অভিভাবকদের প্রশ্ন, শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, পরীক্ষা কমিটির সভাপতি কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি/অবগতি ছাড়া কেন্দ্র সচিব নির্ধারিত সময়ের বাইরে অতিরিক্ত সময় দিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারেন কিনা? পরীক্ষার্থীদের ভুল সংশোধন করলে একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের কেন বাদ দিলেন? দায়িত্বরত শিক্ষকদের ভুলের মাশুল কেন পরীক্ষার্থীরা দিবে? নিজেদের ভুলের কারণে পরীক্ষার্থীদের ক্ষতি ও সৃষ্ট জটিলতার বিষয়ে কেন্দ্র সচিব শিক্ষাবোর্ডকে রিপোর্ট করেছেন কিনা?
তবে নির্ধারিত ২ ঘণ্টার বাইরে সময় দিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন কেন্দ্র সচিব ও মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাহমুদুল করিম ফারুকী। তিনি বলেন, ৩০৩ নং হলের পরীক্ষার্থীরা এমসিকিউ উত্তরগুলো বোর্ডের নির্দেশনা মতো খাতায় লিখেনি। ওএমআর ফরমে ‘বৃত্ত ভরাট’ করেছে। তাই শুদ্ধ করতে ৫মিনিট মতো সুযোগ দেওয়া হয়।
মোহাম্মদ মাহমুদুল করিম ফারুকী বলেন, আমি মাদরাসা বোর্ডের কন্ট্রোলারের সাথে কথা বলেছি। এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। সমস্যা হবে না।
এদিকে, সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সকালে কক্সবাজার ইসলামিয়া মহিলা কামিল (মাস্টার্স) মাদরাসা পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও কেন্দ্র সচিব মোহাম্মদ মাহমুদুল করিম ফারুকী, হল সুপার মনসুর আলম আজাদসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন জেলা শিক্ষা অফিসার মো. নাসির উদ্দিন। এ সময় তিনি হাদীস পরীক্ষা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা দ্রুত নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রিপোর্ট করতে বলেন। সেই সঙ্গে পরীক্ষা গ্রহণে নিয়োজিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেন। শিক্ষা অফিসার বলেন, সঠিক তথ্য না জেনে পরীক্ষার্থীদের নির্দেশনা দেওয়া উচিৎ হয়নি। ছাত্রদের যাতে কোন ধরণের ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, অভিযোগটি পরীক্ষার দিন জানলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারতাম। তবু কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ইসলামিয়া মহিলা কামিল (মাস্টার্স) মাদরাসা কেন্দ্রে প্রায় পরীক্ষায় এমন অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ২০১৭ সালে হাশেমিয়ার আলিমের ছাত্রদের আইসিটি পরীক্ষায় একই হলের ৪৭ জনকে ফেল করে দেওয়া হয়। যা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত মনে করছে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। অথচ ওইসব পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়ার উপযুক্ত ছাত্রও ছিল। এবারও পরিকল্পিতভাবে এরকম ঘটনার আশঙ্কা করছেন মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা রহমত ছলাম।
তিনি বলেন, হল পর্যবেক্ষকসহ দায়িত্বরতদের ভুলের খেসারত পরীক্ষার্থীরা কেন দিবে? এই ক্ষতি মেনে নেওয়া যায় না। উত্তরপত্রে ভুল শুদ্ধ করে দিলে সবাইকে দিবে। কিছু ছাত্রকে ডেকে পরীক্ষা নিলো, কিছু বাদ দিলো কেন? আমার মাদরাসার ছাত্রদের দোষ কোথায়? সবাই তো পরীক্ষার্থী। ছাত্রদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ কেন করা হলো? সঠিক প্রতিকার চাই।