কয়েকদিন ধরেই প্রকৃতিতে পালাবদলের আভাষ পাচ্ছিল কেরামত আলী। রাতে মাঘ মাসের তীব্র শীত অনুভূত হলেও দিনের বেলায় বিশেষ করে দুপুরে গরম পড়ছিল। শীত মোকাবেলায় সকালে ব্লেজার, সু ও মাঙ্কি ক্যাপ পরে বের হলেও বেলা একটু বাড়লে মৃদু গরম পড়ায় শীতবস্ত্রগুলো যেন গলার কাঁটা হয়ে উঠে। আবার সন্ধ্যায় শীতবস্ত্র পরলেও কেমন যেন গরম গরম লাগছিল কয়দিন ধরেই। কনকনে শীতের হাঁড়কাঁপানো উত্তরা বাতাসের পরিবর্তে মনোরম দক্ষিনা হাওয়া বইছিল কয়দিন ধরেই। পাতাঝরা রুক্ষ শীত কেটে গিয়ে প্রকৃতি যেন নবরূপে সাঁজার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। প্রকৃতিতে আরেকটি ঋতু সমাগত, তা যেন বুঝাই যাচ্ছে। প্রতিদিন খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস কেরামত আলীর। রাতের অন্ধকার থেকে সুবহে সাদেক, বিভিন্ন মসজিদের শতাধিক মাইকে ফজরের আজানে মুখরিত পরিবেশ, এরপর সুবহে কাজেব ও ফজর নামাজশেষে সবশেষে পূবাকাশে নব-উষার উদয়। রাত থেকে আরেকটা দিন উদিত হওয়ার প্রাত্যহিক অপার্থিব এ সৌন্দর্য বিনামূল্যে দেখার সূযোগ হাতছাড়া করার মত বোকা নয় সে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে হয়ে অাসা রাতদিনের বিবর্তনের নিয়মিত প্রত্যক্ষদর্শী সে। প্রতিদিনকার মত কাকডাকা ভোরে উঠে ফজর নামাজের পর বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে এসবই চিন্তা করছিল কেরামত আলী। হঠাৎ বউয়ের বাজখাঁই গলার হুংকারে মোহভঙ্গ হল তার। কারন, বাজারে যাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল। এমনিতেই আজকাল কথায় কথায় "দার্শনিক" বলে তাকে খোঁটা দেয় বউ। তিতকুটে বিস্বাদ চা কোনরকমে খেয়ে বরাবরের মতই "অপূর্ব" বলার অভিনয় করে বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরী হল কেরামত। অন্যদিনের চেয়ে আজ বাজারের লিস্টটা একটু যেন লম্বা মনে হল তার। খুঁটিয়ে দেখে, বাজারের প্রাত্যহিক আইটেমগুলোর সাথে নতুন কয়েকটি আইটেম যোগ হয়েছে আজ। কেরামত মাছপ্রিয় মানুষ, তাই বাসার ফ্রিজটা বিভিন্ন প্রজাতির মাছে ঠাসা থাকে সারাবছর। মাছ তেমন একটা কিনতে হয়না। বাজারের অন্যসব অাইটেমের সাথে আজ কয়েকপ্রকার ফুলের ফর্দ-ফরমায়েশ দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকাল কেরামত আলী। কারন আজকাল বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত রান্নার অনুষ্ঠানে রাজ্যের হাবিজাবি রেসিপি দেয়া হয়, আর এর (কু)প্রভাবে কেরামতের বউ আজগুবি যতসব রান্না করে। অতি অখাদ্য এসব রান্না খেয়ে প্রায়ই "হাউ টেস্টি, ওয়ান্ডারফুল, দারুন" বলে অভিনয় করতে অভ্যস্হ কেরামত। আজ আবার ফুল দিয়ে কোন আজব রেসিপি এ্যপ্লাই হবে জানতে চাইলে বাকবাকুম স্বরে তার বউ বলল, আজ নাকি পহেলা ফাল্গুন, বসন্তের শুরু! তাই ফুল দিয়ে মালা গেঁথে সারাগায়ে পরতে হবে, বাসন্তী রং শাড়ী পরে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে হবে, বাসী চটপটি ও ফুচকা খেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ।
তো এত ধরনের ফুল কেন ?
কেরামতকে আস্ত গেঁয়োভূত হিসাবে আখ্যায়িত করে বউ বলল, খোঁপায়, গলায়, মাথায় ও হাতে নাকি ভিন্ন ফুলের মালা পরতে হবে। পায়ের পাতার জন্য বিশেষ কোন মালা প্রয়োজন কিনা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা থাকলেও ভয়ে জিজ্ঞেস করলনা সে। যাই হোক বাজার করতে বের হল সে। শহরের পরিচিত পথ-ঘাট, অলি-গলি কেমন যেন একটু অন্যরকম লাগছে আজ। রিক্সায় সুসজ্জিত যুগলরা গুজুর গুজুর করতে করতে যাচ্ছে। মেয়েদের মাথায় গলায় কিম্ভুতকিমাকার মালা, রংচং মাখা মুখসহ অদ্ভুত এসব সাজসজ্জা নাকি বসন্তবরন !! বিভিন্ন বিউটি পার্লারে নাকি বাসন্তী সাজ'র প্যাকেজ দেয়া হচ্ছে, ভীড়ে ঢুকাই দায়, সবমিলিয়ে মহা কারবার। বেমানান ফুলের মালা পরা কয়েকজোড়া বুড়াবুড়িকেও দেখে নিজেই লজ্জা পেল কেরামত। বসন্ত বরণের উদ্ঘট এ তরিকা কোথা থেকে আমদানী হল, ভেবে কূল-কিনারা পায়না কেরামত আলী। আজ সবচেয়ে জেল্লাই বেড়েছে ফুলওয়ালাদের। ফুল কিনার মচ্ছব, দোকানগুলোর সামনে রীতিমত লাইন। বউয়ের নির্দেশিত ফুল কিনতে একটা দোকানে গেল। কিন্তু ফুল নাকি শেষ। আবার সাপ্লাই আসছে একটু অপেক্ষা করতে বলল ফুলের দোকানী। অগত্যা লাইনে দাঁড়াল সে। এমন সময় বুনো ঝোপঝাঁড় বোঝাই একটা ঠেলাগাড়ী দোকানের সামনে এসে থামল। ঝোপঝাড় ও গাছের ডালপালাগুলো নামিয়ে তোড়া আকারে কায়দা করে বেঁধে মাঝেমধ্যে দুই একটা ফুল গুঁজে দিয়ে বিক্রি করা শুরু করল ফুলওয়ালারা। ফুলের তোড়ার পরিবর্তে গাছের ডাল কেন জিজ্ঞেস করে কেরামত শুনল এটা নাকি আপদকালীন সাপ্লাই ! বউয়ের ভয় সত্ত্বেও এসব দেখে ফুল কিনার ইচ্ছা ত্যাগ করল সে। বাজারে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের বিশেষ করে চাউলের অগ্নিমূল্য দেখে তার মনে বসন্তের পরিবর্তে আষাঢ়ের মেঘ জমতে শুরু করল। বাজার করে বাড়ী ফিরে এলে বউ ফুলের কথা জিজ্ঞেস করল। "আনছি" বলে কেরামত দা নিয়ে বাসার পিছনের ঝোপে গিয়ে গাছের কয়েকটা ডাল কেটে এনে বউকে বলল, আজ ফুলের তোড়ার নামে এসবই বিক্রি হচ্ছে। তাই এ ডালপালাগুলোকে সাইজ করে তোড়া বানাব। একথা শুনে হাতে ধারালো বটি দা নিয়ে রনরঙ্গিনী ভঙ্গিতে কেরামতকে তাড়া করল বউ। প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও পৈত্রিক প্রাণটা বাঁচাতে পরক্ষনেই ভো-দৌঁড় দিল সে। কিছুদুর গিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য বসল সে। বসন্ত বরনে এরকম বিপত্তি মেনে নিতে পারছিলনা বেচারা। এমন সময় দেখল, তার বউ আসছে এ দিকেই। এবার বাগে পেলে তার খবর আছে বিধায় ওসাইন বোল্টের রেকর্ড ভাঙ্গার প্রত্যয়ে আবার শুরু করল দৌঁড়। ছুটতে ছুটতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার জনপ্রিয় একটি গান মনে পড়ল তার,
"আঁরা পুরুষ নির্যাতনর আইন সরকারত্তোন চাই"।
বসন্ত বরনের নামে ভিনদেশীয় আমদানীকৃত অপসংস্কৃতি বন্ধ হবে ও আমাদের সচেতন জনগন ফিরবে সুস্হধারায়, কেরামত আলী স্বপ্ন দেখে।
=========================
আতিকুর রহমান মানিক
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী,
চীফ রিপোর্টার,
দৈনিক আমাদের কক্সবাজার।