বাংলাদেশের মহামারী রোগ কোটা। যার কথা শুনলে বর্তমান সময়ের ছাত্র-ছাত্রী কিংবা চাকুরিপ্রার্থীদের ব্রেইন অকেজো হয়ে যায়। যার প্রয়োগ দেখলে তাঁদের মনে মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এক প্রকার অবহেলা আর চরম বিরক্তিভাব পরিলক্ষিত হয়। কপালে ভাজ পড়ে। ভ্রু কুঁচকে যায়। এ কোটা নিয়ে বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী কিংবা চাকুরি প্রত্যাশীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে, তার চেয়ে বড় ক্ষোভ রয়েছে বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা নিয়ে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন। আর আন্দোলন করতে গিয়ে হতে হয়েছে সরকারি দলের সমর্থক কিংবা পুলিশি নির্যাতনের শিকার। মাঝে মাঝে মনে হয় কোটা বিরোধী হয়ত আরেকটি সংগ্রাম করতে হবে। চাকরিপ্রার্থীদের জন্য কোটা যেন ‘বিষের’ সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কোটার বিষ আর কতকাল পান করতে হবে?
বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটার কথা বলা আছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি/নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ করে, পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য, আর প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে এক শতাংশ কোটা। বাকি ৪৪ শতাংশ মেধা কোটায় বরাদ্দ।
একটি দেশে কোটা পদ্ধতি বরাদ্দ দেওয়া হয় সাধারণত অনগ্রসর জনগণকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ, এই ১৬ শতাংশ কোটা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তবে ১০ শতাংশ জেলা কোটা কিংবা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা নিয়ে শতকরা ৯৫ ভাগ চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীর আপত্তি।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বীর রক্ত দিয়েছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আমাদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার জন্য যারা প্রাণপণ লড়াই করেছেন, তাদের রক্তের প্রতিদান আমাদেরকে অবশ্যই দিতে হবে। এ বিষয়ে রাজাকার ব্যতীত কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
আমার কথা হলো, একজন সৎ লোক প্রতিদান পাওয়ার জন্য কখনো নিজেকে সৎকর্ম করেন না। তা করলে তার সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে অনেকে প্রাণ দিয়েছেন, শারীরিকভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, অনেকে আবার সুস্থ অবস্থায় দেশ স্বাধীন করেছেন। তাদের কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুবিধা ভোগ করবেন, নিঃসন্দেহে সেই মনোবৃত্তি নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। নিশ্চয় তাঁরা জানতেন না যে, বর্তমান সময়ে তাঁদের সন্তানদেরকে রাষ্ট্র প্রদত্ত এই সুযোগ সুবিধা দিবে। যদি তাই ভাবত তাহলে তখনকার সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা এত্ত বেশি হত যে, তা গণনা করা প্রায়ই অসম্ভব হত। মূলত তাঁরা যুদ্ধ করেছেন আবেগের জায়গা থেকে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন আর নিষ্পেষণ থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য, দেশকে স্বাধীন করার জন্য, এজটি স্বাধীন মানচিত্র পাবার জন্য। তাদের প্রতি আমরা আজীবন বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাদের অবদানের প্রতিদান কোনোদিনও শোধ করা যাবেনা। এসব মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিংবা নাতি/নাতনিদের চাকরিতে বিশেষ কোটা সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারটি যদিও ‘সৎ লোকের সন্তানের তার বাবার সৎকর্মের প্রতিদান দাবির’ মতো ঘটনা, তারপরও সে সুবিধা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা থাকত না যদি তা মাত্রাতিরিক্ত না হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাবার অবদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সুবিধা আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে দেব। তারা যদি চাকরি-বাকরিতে বিশেষ সুবিধা পায়, তাতে কারো কোনো আপত্তি নেই। তবে সেটি কতটুকু? আর যাই হোক ৩০ শতাংশ হতে পারে না! আর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরাই বা কেন সেই সুবিধা পাবে?
বিসিএস কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা অনেকক্ষেত্রেই যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। গত ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়। আর ২৮তম বিসিএসে পেশাগত ও কারিগরি ক্যাডারে বিভিন্ন কোটায় ৮১৩টি পদের জন্য কোনো যোগ্য প্রার্থীই পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতি কোটা ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি থাকে। পরে এসব পদে নিয়োগ দিতে ৩২তম বিশেষ বিসিএস হয়। এবারও হয়তো মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা পূরণ হয়নি বলেই পিএসসি মেধা ও অন্যান্য কোটা আলাদা করে ফল প্রকাশ করেনি। যেখানে মেধাবীরা ভালো পরীক্ষা দিয়েও বিসিএসে কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরিতে সুযোগ পাচ্ছে না, সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অপূরণ থাকায় লোক না নেওয়াটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি দেশে বেকারত্ব বাড়াচ্ছে, যুবকদেরকে হতাশার পথে ঠেলে দিচ্ছে।
তারপরও হয়তো মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন থাকত না, যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা এর সুফল পেতেন। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য কোটা বরাদ্দ এবং এমন লোকদের জন্য চাকরিতে বয়সে বিশেষ সুবিধা প্রণয়নের পর থেকে দেশে ‘মুক্তিযোদ্ধার’ সংখ্যা ভয়ানক হারে বেড়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নানা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, অথচ বহু স্বার্থান্বেষী মানুষ অসদুপায়ে তার নিজের, বাবার কিংবা দাদা/নানার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বের করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা তার সন্তান/নাতি/নাতনি হয়ে যাচ্ছেন।
যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যারা নিজেরা কিংবা তাদের সন্তান/নাতি/নাতনিরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা ভোগ করছেন। নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, টিউশন কিংবা পার্ট টাইম চাকরি করে বহু কষ্টে পড়াশোনা করেও চাকরি পাবে না, আর অমেধাবীরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে বিসিএসের মতো চাকরি পেয়ে যাবে, তা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন চাকরি ব্যবস্থাপনায় অন্যায় হচ্ছে, অন্যদিকে অনেক অমেধাবীরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যাচ্ছে, ফলে দেশ একটি ‘মেধাশূন্য’ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কি তাদের দিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে? সময় এসেছে এসব ভাবার। তা নাহলে দেশের শিক্ষিত মেধাবীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে দেশের লাভই বা কী?
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির প্রয়োগ নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ শাসনামল এবং পাকিস্তান জামানা পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করা হয়। ওই সময় তাদের অবদান ও বিড়ম্বনার কথা বিবেচনা করে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পরেও জন্ম নেওয়া তাদের সন্তান কিংবা নাতি/নাতনির বেলায় এটা প্রয়োগের কোনো যুক্তি কি আদৌ আছে? সংবিধানে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির কথা বলা হলেও সেই অনগ্রসর জনগোষ্ঠী কারা এবং কত দিন ধরে তাদের কোটা দেওয়া যেতে পারে তা নতুন করে ভাবতে হবে।
১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন সদস্য বাদে সবাই সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কোটার পক্ষে অবস্থা নেওয়া এম এম জামান প্রচলিত কোটাগুলো প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালেই এই কোটা ব্যবস্থাকে আরো সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা প্রক্রিয়াটি কখনো সরল-সোজা ছিল না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই জটিলতা সৃষ্টি করে। ক্ষেত্রবিশেষে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হয়। তাই কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সংস্কার জরুরি। এটা সত্য, কোটা ব্যবস্থা একেবারে বাতিল হওয়ার পর্যায়ে এখনো আমরা উপনীত হইনি। তবে বিদ্যমান আনুপাতিক হার কমিয়ে যৌক্তিক অবস্থায় আনতে হবে। সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। সেক্ষেত্রে কোটা শুধু গরিব ও দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে প্রাধিকার কোটা ৩০ শতাংশের বেশি গ্রহণযোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বাকি ১৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে, কোটা হলো বিশেষ ব্যবস্থা, অন্যদিকে মেধা কোটা হলো সাধারণ ব্যবস্থা। কোটা প্রবর্তন করা হয়, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে সমতালে তোলার জন্য। তবে প্রাধিকার কোটা কোনোভাবেই মেধা কোটার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা পাগলামি। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে কখনোই মূল (মেধাবী) জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা চলবে না, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
বছর কয়েক আগে পিএসসির এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রচলিত কোটা পদ্ধতির কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন নিখুঁতভাবে শতভাগ করা সম্ভব নয়।
সবশেষে বলতে চাই, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে, কিভাবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়। এ দেশ আমাদের সবার। চাকুরির প্রতিযোগিতার বাজারে কোনো বিভাজন কাম্য নয়। আর দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে মেধাবীদের স্থান পাওয়াটা খুবই জরুরি। কোটার ফাঁদে পড়ে মেধাবীরা যেন চাকরি বঞ্চিত না হয় এবং অমেধাবীরা যেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢুকে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। না হলে খাল কেটে কুমির আনার মতই সর্বনাশ হবে আমাদের দেশেরই।
লেখক-
এম. জসিম উদ্দিন
সাবেক সভাপতি
উখিয়া স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।