নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার পর আদালতের দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সৌদি গেজেট। সৌদি আরবের ওই পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে দেশটির সাবেক কূটনীতিক ড. আলী আল গামদী ‘কোন পাপে নিজামীকে ফাঁসি দেয়া হল’ এমন প্রশ্ন তুলে এক নিবন্ধ লিখেছেন। এ নিবন্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এ বিচারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন উঠানো হয়েছে।
কূটনীতিক ড. আলী আল গামদী সৌদি সরকারের দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রতিবেদনে লেখা হয়, অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বিরোধী দলের নেতা ও জামায়াতে ইসলামের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকরা আন্তর্জাতিক অনুরোধ উপেক্ষা করেই সাবেক এ মন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের সদস্যকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটিবি) দেয়া অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ রায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা বিরোধী নেতাদের মধ্যে মাওলানা নিজামী হচ্ছেন পঞ্চম। এ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার ও জবাবদিহিতার জন্য। কিন্তু এ বিচারের পদ্ধতিগত অনিয়ম, বিচারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে কারসাজি ও আইনি পক্ষপাতদুষ্টতা এর বৈধতাকে কলঙ্কিত করেছে।
৪৫ বছর আগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সাধারণ মানুষের যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, সে সময়ে করা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ঐ যুদ্ধে অখ- পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রহসনমূলক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করার পর নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যেখানে বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের মৌলিক বিষয়গুলো পর্যন্ত অনুসরণের অভাব ছিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডস এবং স্থানীয় আন্তর্জাতিক প্রায় সকল মানবাধিকার সংগঠনগুলো ট্রাইব্যুনাল ও এর বিচার প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিরুদ্ধে গিয়েছে বলে ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে আমেরিকার এক রাষ্ট্রদূত ও এক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞের নাম উল্লেখযোগ্য।
প্রতিবেদনে উল্লেখ, এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও অনুরোধে কোনো কর্ণপাতই করেনি বাংলাদেশ সরকার। এই সরকার এখনও বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনছে। যদিও ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার শাসনামলে কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করেননি। এমনকি মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
নয়া দিল্লিতে হওয়া বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে শেখ মুজিব রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন।
বাংলাদেশের দলগুলোর মধ্যে পুনরায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এ চুক্তিটি করা হয়েছিল। এ সবকিছুই করা হয়েছিল ‘ভুলে যাও এবং ক্ষমা করো’ এই নীতির ভিত্তিতে। সেই সময় শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবী জানুক, বাঙালিরা কিভাবে ক্ষমা করতে পারে।’
মুজিবকন্যা ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে কখনই এ বিচারের কথা বলেননি তিনি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এখন যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগ ইতিপূর্বে আনা হয়নি।
এটি প্রমাণ করে, বিরোধী দলের নেতাদের নির্মূলের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোকে অত্যধিক দুর্বল করতেই শেখ হাসিনা এই কৌশল নিয়েছেন। যাতে করে তিনি বাংলাদেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
শেখ মুজিবের প্রধান শত্রু বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ জোট বেঁধে ২০০৮ সালে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে।
এবারের মেয়াদকালে তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করেন। প্রকৃতপক্ষে, শুধু নামটি ছাড়া এই ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক কিছুই নেই। এই ট্রাইব্যুনালে কোন আন্তর্জাতিক বিচারকও নেই। অধিকন্তু, যুদ্ধাপরাধের সন্দেহে অভিযুক্তদের পক্ষে কোন আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিশেষজ্ঞ ও বিখ্যাত আন্তর্জাতিক আইনবিদ টবি এম ক্যাডম্যানকেও বাংলাদেশে প্রবেশে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। এমনকি, ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পর তাকে সেখান থেকেই ফেরত পাঠানো হয়। আসামী পক্ষের স্থানীয় আইনজীবীরা কাজ করতে আসলে তাদেরও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়া হয়। এক আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়, অন্য একজনকে হুমকি দেয়া হয় এবং যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কাজ করতে ইচ্ছুক এমন প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করা হয়।
মাওলানা নিজামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং কৃষি ও শিল্প বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বিচারে আন্তর্জাতিক মান ও নিয়ম বজায় রাখা হয়নি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আসামি পক্ষের আইনজীবীদেরকে তাদের মক্কেলের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য মাত্র ২০ দিনের সময় দেওয়া হয়। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সময় দেওয়া হয় প্রায় ২ বছর। একইভাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ২৬ জন সাক্ষীর অনুমোদন দেওয়া হয়। অন্যদিকে আসামীর পক্ষে মাত্র ৪ জন সাক্ষী হাজিরের অনুমোদন দেয়া হয়। এসব কিছু স্পষ্ট করে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
এখানে কোনো সন্দেহ নেই, এ ট্রাইব্যুনাল ও এর রায়ের সঙ্গে জড়িতরা ইতিহাসে জায়গা করে নেবে, যে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কয়েকজন নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল শুধু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার উপর আঘাত হানবে না, এটি দেশের ও শেখ মুজিবুর রহমানের সুনামেও আঘাত হানবে। শেখ মুজিব পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তাকারীদের ‘ভুলে যাও ও ক্ষমা করো’ এই নীতির ভিত্তিতে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
চূড়ান্তভাবে পর্যবেক্ষক টবি এম ক্যাডম্যানের উদ্ধৃতি বলতে চাই। হাফিংটন পোস্টের ওয়েবসাইটে তিনি লিখেছেন, ‘নিজামীকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ক্যাডম্যান ওই নিবন্ধে বলেন, ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিমকোর্টের দেওয়া রায়ে আন্তর্জাতিক বিচারের মানদণ্ড বজায় ছিল না।’
আন্তর্জাতিক আইন বিশারদরা নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকরের দুই দিন আগে সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ওই বিবৃতিতে ইন্ডিপেডেন্ট গ্রুপ অব প্রসিকিউটরস ও জাজেজ ও একাডেমিকদের স্বাক্ষর ছিল। সেখানে তারা বলেছিলেন, এই ট্রাইব্যুনালে হাজির করার পরে তাদেরকে ন্যায় বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে সরকারকে এই রায়ের বৈধতা নিয়ে কথা বলতে হবে।