নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনাকালীণ সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং আনুষঙ্গিক আরও কিছু কারণে কক্সবাজার জেলায় আশংকাজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ে। জেলার ৯টি উপজেলার ৩২টি ইউনিয়ন এবং ৩টি পৌরসভায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা যায়।
শনিবার (২ অক্টােবর) দুপুরে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে গবেষণার এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাল্যবিয়ের জাতীয় গড় হার ৫১.৪% হলেও ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার কারণে কক্সবাজার জেলায় বাল্যবিয়ের হার কয়েকটি জেলায় জাতীয় এই হারে চেয়ে অনেক বেশি। ঈদগাঁও উপজেলায় সর্বোচ্চ ৮২%। এর পরেই রয়েছে উখিয়া উপজেলা ৭৫%।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন সংস্থার সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি উল্লেখ করেন, প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ঈদগাঁও ও উখিয়ার পরে উপজেলায় বাল্যবিবাহের হার তুলনামূলক সবচেয়ে বেশি রামু উপজেলায় ৭২%, টেকনাফে এটি ৬৬%, মহেশখালীতে ৬১%, কুতুবদিয়ায় ৫৪%, কক্সবাজার সদরে ৫১% এবং সবচেয়ে কম চকরিয়া ও পেকুয়ায় যথাক্রমে ৩২% এবং ২৬%।
বাল্যবিয়ের বহুমাতৃক প্রভাব নিয়ে অপর এক উপস্থাপনায় সংস্থাটির যুগ্ম পরিচালক মোঃ মুজিবুল হক মুনির বলেন, বাল্যবিয়ের ফলে দেশে নারীর আয় ৯% এবং জাতীয় আয় ১% কমে যায়। বাল্যবিয়ে নিরসন করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা বাজেটে ১১% অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব।
সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জরিপের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে ২০২০ এবং ২০২১ সালে বাল্যবিয়ে সংঘটিত হয়েছে এমন পরিবারগুলো থেকে ৩৮৪ জন উত্তরদাতার সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়েছে। উত্তরদাতাতের মধ্যে নারী ছিলেন ৪৮% এবং পুরুষ ৪২%। আর তাদের পরিবারগুলোর মধ্যে নারী সদস্যের বাল্যবিয়ে হয়েছে এমন হার ছিলো ৬৩% আর পুরুষ বাল্যবিয়ের হার ৩৭%। গত ৪ আগস্ট থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ কক্সবাজার জেলার সকল উপজেলায় এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
জরিপে অংশগ্রণকারীদের ৬৩% উত্তরদাতা মনে করেন যে, করোনাকালীন বাল্যবিয়ের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের মধ্যে ৪৭% উত্তরদাতা মনে করেন দীর্ঘ সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা এ সময়ে বাল্যবিয়ের হার বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ। এছাড়া ২৬% উত্তরদাতা মনে করেন অর্থনৈতিক দৈন্য এবং ২২ % মনে করেন করোনাকালীন কর্মহীন হওয়ায় ভবিষ্যত অনিশ্চিত ভেবে অনেকেই ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, উত্তরদাতাদের মধ্যে যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক পাশের চেয়ে বেশি তাদের পরিবারে বাল্যবিবাহের হার মাত্র ৫% শতাংশ। বিপরীতে যেসব পরিবারের সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এর চেয়ে কম তাদের পরিবারে বাল্যবিবাহের হার ৩৫% এবং যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্বাক্ষর দেয়া র্পযন্ত সীমাবদ্ধ, সেসব পরিবারে বাল্যবিবাহের হার ৫২%। এছাড়া আর্থিক বিবেচনায় নিম্নবিত্ত পরিবারে বাল্যবিয়ের হার ৬৪%, মধ্যবিত্ত পরিবারের ৩২% এবং উচ্চবিত্ত পরিবারে মাত্র ৪%। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তরদাতারা একাধিক উত্তর বেছে নেন। এদের মধ্যে ৬৫% মনে করেন ভূয়া জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি বন্ধ করা গেলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়া ৬৪% মনে করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হলে বাল্যবিয়ে অনেকাংশে কমে যাবে, যা ইতোমধ্যে খুলে দেয়া হয়েছে। অন্যান্যদের মধ্যে ৩৮% মনে করেন আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং ৩২% মনে করেন দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ন্যায় কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে বাল্যবিয়ের হার কমে যাবে। পাশাপাশ স্থানীয় পর্যায়ে বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিকগুলি তুলে ধরে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমেও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আলোচনায় অংশ নিয়ে সাংবাদিক হুমায়ুন কবির জুসান বলেন, জাতিসংঘ এজেন্সি এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো এখানে জনজীবন উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, তার পরেও কেন কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭৫%? এর উত্তরণে আমাদের সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে।
ফারুক আহমেদ বলেন, উখিয়াতে কয়েক বছর আগে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নকে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষণা করা হয়, তাই করোনাকালীন বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির এই হার আশংকাজনক। বাল্যবিয়ে রোধ অর্থনৈতিক সহায়তা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সকলকে কাজ করতে হবে। এইচ এম নজরুল ইসলাম বাল্যবিয়ের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে মত দেন। সরোয়ার আজম মানিক বাল্যবিয়ে রোধে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা আরো বৃদ্ধি ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সচেতনতা গড়ে তোলার কথা বলেন।
বাল্যবিয়ের বহুমুখি কারণ প্রতিকার নিয়ে আরো বক্তব্য রাখেন- ইমাম খাইর, ওবাইদুল হক চৌধুরী, পলাশ বড়ুয়া, নেজাম উদ্দিন, এহসান আল কুতুবী, শাহিনুর ইসলাম, ফেরদৌস আরা রুমি, ইকবাল উদ্দিন প্রমুখ।
পাঠকের মতামত