জসিম মাহমুদ ::
টেকনাফ উপজেলার দিনমজুর আব্দুল আলীর কিশোর ছেলেকে দুই সপ্তাহ আগে অপহরণ করে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। পরে নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা।
ছেলেকে ফিরে পেতে আব্দুল আলী (ছদ্মনাম) এক থানা থেকে আরেক থানায় গিয়ে সহায়তা চেয়েছেন। কোনো জায়গা থেকে সাড়া না পেয়ে অবশেষে যান র্যাবের কাছে। র্যাব জানায়, ক্যাম্পের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি তাদের নেই।
বাহারছড়ার বড় ডেইল এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলী বলছিলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। আমার ছেলেটাকে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে নির্যাতন করে। তখন ঘর-ভিটা বন্ধক রেখে, পাড়ার মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে দুই লাখ টাকা জোগাড় করি। পরে মুচনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প বাজারে গিয়ে অপহরণকারীদের হাতে হাতে সেই টাকা দিয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছি।’
অপহরণ থেকে ফিরে আসা আব্দুল আলীর কিশোর ছেলেও (১৫) বলছিল, কথাবার্তা শুনে সে বুঝতে পেরেছে, অপহরণকারীরা সবাই রোহিঙ্গা। তাদের কাছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রান্না করা খাবার আসত।
এক সময় ‘ক্রসফায়ারের’ নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য কুখ্যাতি কুড়ানো টেকনাফ উপকূলে নতুন আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ‘অপহরণকাণ্ড’; যেখানে মুক্তিপণ দিয়েও কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না।
স্থানীয়দের ভাষ্য, এমন কোনো দিন নেই, যেদিন অপহরণ বা মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা না ঘটছে। আগে ছিল ‘ক্রসফায়ারের’ লীলাভূমি; এখন হয়েছে অপহরণের ‘স্বর্গরাজ্য’।
শুরুতে স্থানীয় অপরাধীদের সঙ্গে যোগসাজসে এসব চললেও এখন রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেছে, যাদের শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ও স্থানীয় জনগণ- দুই পক্ষই।
অপহরণের ঘটনার খুব বেশি অভিযোগ বা মামলা স্থানীয় থানায় নেই। তবে স্থানীয় সংবাদকর্মীরা এসব অপহরণের ঘটনার তথ্য সংগ্রহে রাখেন। এক হিসেবে দেখা যায়, এক বছরে টেকনাফ উপজেলায় অন্তত ১৯৩ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯১ জন স্থানীয় বাসিন্দা; বাকিরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের।
এদের অধিকাংশই ফিরে এসেছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপহৃতদের ‘উদ্ধারের’ দাবি করলেও; ভুক্তভোগীদের পরিবার বলছে, অন্তত দেড়শ জন মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছে। এদের মধ্যে স্থানীয় কৃষক, শ্রমিক, কাঠুরিয়া, বনকর্মী, অটোরিকশা ও টমটম চালক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, পর্যটক যেমন রয়েছেন তেমনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশু ও পুরুষরাও আছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছিলেন, মুক্তিপণের টাকা নির্ধারণ হয় ভুক্তভোগী পরিবারের আর্থিক সংগতির ওপর। ক্যাম্পের লোক হলে সেখানকার বাসিন্দারা এ ব্যাপারে অপহরণকারীদের তথ্য দেয়। আর বাইরের লোক হলে স্থানীয় সহযোগী অপরাধীদের কাছ থেকে তথ্য পায় অপহরণকারীরা। সমঝোতার ভিত্তিতে মুক্তিপণের টাকা ১৫-২০ হাজার থেকে ১৪-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় অপহৃতদের অবস্থান জানার চেষ্টা করে পুলিশ। অপহরণের ঘটনায় গত এক বছরে ১৯টি মামলায় ২৯ অপহরণকারীকে আটক এবং অপহৃত ৬০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। অপহরণের ঘটনাগুলো কোন কোন পয়েন্টে হয়, সেটি নির্ধারণ করে সেখানে নজরদারি ও টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়া ইউনিয়নেয় অপহরণের ঘটনা বেশি। এই তিন ইউনিয়নের মধ্যে বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া, বড় ডেইল, মাথাভাঙা, জাহাজপুড়া, ভাগগুনা, মারিশবনিয়া, হোয়াই্যকংয়ের ঢালা, চৌকিদারপাড়া, দক্ষিণ শীলখালী গ্রামের মানুষ বেশি অপহরণ আতঙ্কের মধ্য থাকেন।
উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বলছিলেন, তার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের অন্তত ৭০০ পরিবার অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। কিছু দিন আগেও এসব গ্রামের তিনজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়।
‘অপহরণ বাণিজ্যে স্থানীয় কিছু অপরাধীরা জড়িত রয়েছে। মূলত পাহাড়ি এলাকাগুলোয় বেশ কয়েকটি অপহরণ চক্র সক্রিয়। স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তি ও রোহিঙ্গা মিলে বিভিন্ন অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে।’
ইউপি চেয়ারম্যান মনে করেন, শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এর মোকাবিলা করা যাবে না; পাহাড়ে অপহরণ রোধে সেনা অভিযান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একই ধরনের দাবি করেছেন টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফরিদুল আলম। তিনি বলছিলেন, ‘আমার এলাকাটি এখন অপহরণের ‘হটস্পট’। এখান থেকেই শতাধিক মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে।’
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্ধারের ‘গল্প’ নিয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও তিনি খুব জোরের সঙ্গেই বলছিলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নয়; বরং সবাই মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত এসেছে।’
কেন গহীন পাহাড়ের পাদদেশের টেকনাফ উপকূল অপহরণের ‘হটস্পট’ হয়ে উঠল এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে নানা কারণ জানা গেছে।
এর মধ্যে মানবপাচার, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, রোহিঙ্গাদের অপরাধ সংশ্লিষ্টতা, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিশাল জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বল্পতা- এসব কারণকেই সামনে আনছেন কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন।
তার ভাষ্য, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাস বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটে, কারণ এই সময়টা শুষ্ক মৌসুম। দুর্গম পাহাড়ে অবস্থান ও চলাচলে সুবিধা হয়।
পাহাড়ে যেতে ভয়, আতঙ্কে বনকর্মী
১ জানুয়ারি সকালে টেকনাফের জাদিমোড়া পাহাড়ে গাছ লাগাতে গিয়েছিলেন বনবিভাগের ১৮ কর্মী ও শ্রমিক। কাজ করার ফাঁকে তারা একটা পানির ছড়ার কাছে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় ১০-১২ অস্ত্রধারী তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। সবাই মুখোশ পরিহিত ও তাদের কাঁধে ব্যাগ ছিল। হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র ও বড় বড় দা। অস্ত্রের মুখে সবাইকে বেঁধে রোহিঙ্গা শিবিরের পশ্চিমে গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায় তারা।
অপহৃতদের মধ্যে টেকনাফের জাদিমোড়ার বাসিন্দা জুহুর আলমের ছেলে সাইফুল ইসলামও ছিলেন। তিনি বনবিভাগের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে সাইফুল বলেন, ‘গহীন পাহাড়ের একটি গুহায় নিয়ে সবাইকে মাটিতে শুইয়ে দেয়। পরে আমাদের মোবাইল ফোন নিয়ে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা আদায়ের জন্য বেশি মারধর করে আমাদের। সঙ্গে থাকা খাবারও নিয়ে খেয়ে ফেলে অপহরণকারীরা। সারারাত পানি ছাড়া আর কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। পরদিন সকালে অপহরণকারীদের একজনের কাছে ফোনে খবর আসে র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান শুরু করছে। তখন সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। আমাদের কয়েকজনকে হত্যা করার ঘোষণা দেয় তারা। মাটিতে ফেলে মারধরও শুরু করে। একপর্যায়ে মাথায় মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে দ্রুত মুক্তিপণ আদায়ের জন্য চাপ দেয়।’
সাইফুল বলেন, ‘আমার পরিবার থেকে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নেয়। এভাবে সবার কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে লোকালে এনে আমাদের ছেড়ে দেয়। তাদের ব্যবহার, কথাবার্তা ও নির্যাতনের স্টাইল দেখে মনে হয়েছে তারা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী।’
সাইফুলের সঙ্গে সেদিন একই এলাকার শাকিল আহমেদও অপহৃত হয়েছিলেন। তিনিও একইসঙ্গে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন।
শাকিলের বাবা লেদু মিয়া বলছিলেন, ‘২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেলেকে ফেরত দিয়েছে অপহরণকারীরা। আমি দিনমজুর হওয়ায় টাকা জোগাড় করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। আমাদের বাড়ি পাহাড়ের পাদদেশে; কৃষিকাজে শ্রম দিয়ে আমাদের সংসার চলে। তাই আবারও অপহরণের ভয়ে কোনো মামলা করিনি। খুব ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছি। আমার ছেলের সঙ্গে অপহৃত সবাই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরছিল।’
এ ব্যাপারে টেকনাফ বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ বলেন, ‘অপহরণের ভয়ে শ্রমিকরা কাজ করতে যেতে চাচ্ছেন না বনে। আপাতত অপহরণের ঝুঁকির কারণে ওই এলাকায় কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।’
বনবিভাগের কর্মী ও শ্রমিক অপহরণের ঘটনায় অজ্ঞাত ২৫-৩০ জনের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মামলা করেছেন জানিয়ে রেঞ্জ কর্মকর্তা রশিদ বলেন, ‘অপহৃতরা কাউকে চিনতে পারেননি। দেখলে শনাক্ত করতে পারবেন বলে তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।’
এখন যেসব এলাকায় অপহরণের ঝুঁকি আছে, সেখানে অস্ত্রসহ নিরাপত্তারক্ষীর মাধ্যমে কাজের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান বনবিভাগের এই কর্মকর্তা।
১৫ লাখ টাকা দিয়ে ফেরেন জসীম
বনবিভাগের ১৮ কর্মী ও শ্রমিক যেদিন অপহরণের শিকার হন, তার ঠিক দুদিন আগে ৩০ ডিসেম্বর অপহৃত হন বাহারছড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ বড় ডেইল মুদি দোকানি জসীম উদ্দিন।
সেদিন তিনি প্রতিদিনের মত দোকানের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বাইরে থেকে দোকানের শাটারে তালা দিতে যাবেন, এমন সময় দেখতে পান, ১৭-১৮ জন অস্ত্রধারী তাকে ঘিরে ফেলেছে।
কোনো কথা বলতে না দিয়ে তাকে নিয়ে পাহাড়ের গহীনে চলে যায় দলটি। পরে সেই একই কায়দায় নির্যাতন করে ভিডিও ধারণ করে সেটি পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। মুক্তিপণ চাওয়া হয় ৫০ লাখ টাকা।
জসীম বলেন, ‘তারা তখন আমাকে পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে দিয়েছে। আমি যখন কথা বলছিলাম, তখনও নির্যাতন করা হয়।’
জসীমের আপন ফুফাত ভাই বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফরিদুর আলম।
তিনি বলছিলেন, ‘নির্যাতন ও মারধরের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠানো হলে তারা ভয় পায়, ভেঙে পড়ে। এত টাকা কোথায় থেকে দেবেন তারা? পরে নিজের ঘর-ভিটা বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করে অপহরণকারীদের মুক্তিপণ দেওয়া হয়। নয়দিনের মাথায় আমার মামাত ভাইকে সন্ত্রাসীরা ছেড়ে দেয়।’
ফিরে আসা জসীম বলছিলেন, ‘সন্ত্রাসীরা টাকার জন্য আট দিন খুব বেশি নির্যাতন করেছে। শরীরের বিভিন্ন ধরনের আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরে চট্টগ্রামে গিয়ে একটি ক্লিনিকে আমি চিকিৎসা নিই।’
জসীম ও ফরিদুল উভয়েই বলছিলেন, এটা একটা বিরাট চক্র। যতক্ষণ স্থানীয় মানুষ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনপ্রতিনিধিরা যৌথভাবে এর মোকাবিলায় কাজ না করবেন, ততদিন অপহরণ রোধ করা অসম্ভব।
এ ব্যাপারে টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘শক্ত হাতে অপহরণকারীদের দমন করতে হবে। বিশেষ করে যারা পাহাড়ি সংলগ্ন স্থানে কৃষি-ক্ষেত খামার করে, ওই সব এলাকায় যারা বসবাস করেন, তারা অপহরণ আতঙ্কে থাকেন।
‘অপহরণ বাণিজ্য বন্ধ করতে হলে পাহাড়সহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান দরকার। অপহরণকারী আটক করে তাদের সঙ্গে কারা জড়িত এদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
‘ভয়ে কেউ পার্কে যায় না’
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বিভিন্ন সময়ে ২০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উপকূলের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে শরণার্থী হিসেবে রয়েছেন। এখনও সেই আসা অব্যাহত আছে। সরকারি হিসেবেই, যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে গত তিন-চার মাসে আরও প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গাদের স্থানীয় বাসিন্দারা শুরুতে স্বাগতই জানিয়েছিল। যে যেভাবে পেরেছে তাদের সহায়তা করেছেন।
কিন্তু রোহিঙ্গা সংখ্যাধিক্যের কারণে স্বভাবতই স্থানীয় বাসিন্দারা এক ধরনের ‘সংখ্যালঘুতে’ পরিণত হয়েছেন। ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গাদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে।
বাইরে রোহিঙ্গাদের চলাচল, কর্মসংস্থান, তাদের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া- এসব কারণে স্থানীয়রাও এখন রোহিঙ্গাদের প্রতি ক্ষুব্ধ। রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা মোকাবিলায় স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সংগঠনও গড়ে ওঠেছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি এরকমই একটি সংগঠন। এর সভাপতি মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘এখন রোহিঙ্গারা মাদক ব্যবসা, অপহরণ বাণিজ্য, অস্ত্র ব্যবসা থেকে শুরু করে গুম-খুনের মত বড় অপরাধে জড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে অপহরণ বাণিজ্যে সরাসরি জড়িত রোহিঙ্গারা। তারা আসার আগে অপহরণ বলে কিছুই ছিল না টেকনাফে। অপহরণের ঘটনাগুলো আগে রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক হলেও এখন তা পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করা হলেও কিছুদিন পরে জেল থেকে বেরিয়ে আসে। তারা আবার অপহরণে যুক্ত হয়।’
তিনি মনে করেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন ছাড়া মনে হয় না এ থেকে মুক্তির আমাদের আর কোনো বিকল্প আছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন টেকনাফ উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আবুল হোসেন রাজু বলেন, ‘আজ থেকে তিন বছর আগেও টেকনাফ নেচার পার্কে জেলা শহরসহ সারাদেশ থেকে পর্যটক আসতেন। সেখানে বানর, হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু দেখা যেত। আমরাও আমাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে অবসরে সেখানে গিয়ে নির্মল শ্বাস নিতাম। কিন্তু এখন সেখানে অপহরণের ভয়ে যেতে চায় না মানুষ।’
তিনি বলেন, টেকনাফে অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য বর্তমানে খুবই ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে। স্থানীয়রা এই ভয়াবহতার শিকার। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে বেড়ে উঠেছে একাধিক অপহরণ চক্র।
‘দ্রুত সময়ের মধ্যে অপহরণ বন্ধ না হলে স্থানীয়দের কঠিন পরিস্থিতিতে দিন পার করতে হবে। তাই সেনাবাহিনীসহ সব প্রশাসনকে একত্রে পাহাড়ে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করার জন্য জোর দাবি জানাই।’
অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকা অস্ত্রধারী এক রোহিঙ্গা যুবকের একটি ছবি সম্প্রতি প্রতিবেদকের হাতে আসে। সেই ছবিটি নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পের মাঝিদের (ক্যাম্পভিত্তিক রোহিঙ্গা নেতা) সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের সাংবাদিকরা।
অপহরণে জড়িত নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ শফি। অপহরণে জড়িত নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ শফি।
মাঝিরা দাবি করেন, অস্ত্রধারী ওই যুবকের নাম মোহাম্মদ শফি। তিনি নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি ব্লকের বাসিন্দা।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে।
রোহিঙ্গা মাঝিদের দাবি, শফি ছিল ‘সালমান শাহ গ্রুপ’ এর সেকেন্ড ইন কমান্ড। এখন আলাদা হয়ে নিজেই বাহিনী তৈরি করেছেন।
২০২২ সালের ৫ মে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএনের হাতে আটক হয়ে কারাভোগও করেছেন শফি। পরে জামিনে বের হয়ে আবার অপহরণে যুক্ত হয়েছেন। পাহাড়ে তার নেতৃত্বে এখন ত্রাস চলছে।
কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘দুর্গম পাহাড়ে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি অভিযানে অনেককে গ্রেপ্তারও করেছে র্যাবের আভিযানিক দল। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর দীর্ঘ অভিযানে বনে অপহৃত ১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।’
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সব তথ্য নিয়ে এগোচ্ছি। অপরাধী চক্রকে সমূলে বিনাশ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে স্থানীয় জনগণ এবং প্রতিনিধিদেরও এক সঙ্গে কাজ করলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে।’
প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য
রোহিঙ্গাদের সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়। কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, তারাও বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকেও নানা নির্দেশনা দিয়েছেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এজেন্সিগুলোকে বলেছি গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে। এপিবিএনও কাজ করছে। রেজিস্ট্রার্ড মোবাইল নাম্বার না থাকায় অপরাধীদের শনাক্ত করতে বেগ পেতে হয়।’
অপহরণ ‘বিচ্ছিন্ন’ কোনো ঘটনা নয় মন্তব্য করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘এসবের বেশিরভাগ ঘটনায় মাদক ও মানবপাচারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর টাকা-পয়সার জন্য গ্রুপগুলো অপহরণের দিকে বেশি ধাবিত হচ্ছে।’
তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক কতগুলো গ্রুপ আছে তার কোনো তালিকা নেই বলে জানিয়েছেন সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএনের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ সিরাজ আমিন। তিনি বলছিলেন, এ ধরনের কোনো তালিকা তাদের নেই। তবে বিভিন্ন ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর তারা জড়িতদের ধরতে কাজ করে থাকেন।
১৬ এপিবিএন এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. কায়সার শিকদার বলেন, তারা মূলত ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেন। অপহরণের সঙ্গে জড়িত চক্রগুলোর অবস্থান ক্যাম্পের বাইরের পাহাড়ে। ফলে সেই অভিযান চালানোর অনুমোদন তাদের নেই।
অপরাধের ঘটনা ঘটলে তারা জেলা পুলিশ এবং র্যাবকে অভিহিত করেন। তখন তারা অভিযান চালায়।
টেকনাফের দায়িত্বে থাকা র্যাব-১৫ এর স্কোয়াড্রন লিডার তৌহিদুল মবিন খান বলেন, তাদের কাছে তথ্য আছে, পাহাড়ে কয়েকটি সশস্ত্র ডাকাত গ্রুপ সক্রিয়। তাদের আস্তানা চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন বলেন, ‘এরই মধ্যে উপরমহল থেকে নির্দেশ এসেছে। শিগগিরই বিশেষ ফোর্স নিয়ে পাহাড়ে অভিযান শুরু হবে।’
জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তাও বলছিলেন, তাদের কাছে চিহ্নিত কোনো সন্ত্রাসীর তালিকা নেই।
আর অপহরণের সঙ্গে জড়িত এসব গ্রুপের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা কিংবা আরএসও এর সম্পৃক্ততাও পাননি বলে জসীম উদ্দিনের ভাষ্য।
পাঠকের মতামত