আবদুর রহমান বদি। কক্সবাজার-৪ আসনের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ছিলেন, তাও আবার ক্ষমতাসীন দলের টিকিটে। মাদক কারবারসহ নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনায় তিনি থাকেন, এখনো আছেন। এমপিত্বে সাবেক হলেও দাপট তার কমেনি, প্রভাব-প্রতিপত্তিও কমেনি। মাদকের কারবারে, মুখ্যত ইয়াবার কারবারে, তার খ্যাতি বা কুখ্যাতির কথা শুধু টেকনাফবাসী নয়, দেশবাসী জানে। বদির আপন ভাইসহ অন্য স্বজনরাও জড়িয়ে আছেন ইয়াবা কারবারে। বদি দুদকের মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন একসময়। সমালোচনার ঝড় ওঠায় আওয়ামী লীগ তাকে আর মনোনয়ন দেয়নি। দেওয়া হয়নি আওয়ামী লীগের পদ-পদবিও। কিছুদিন দূরে ছিলেন রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেও। কোনো ধরনের তৎপরতা বদির ছিল না বা থাকলেও চোখে পড়ত না। এলাকা ছেড়ে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। তবে তদবিরের তৎপরতা তার ছিল, নিজে মনোনয়ন না পেলেও আদায় করে নেন স্ত্রীর মনোনয়ন। স্ত্রী পরপর দুবার এমপি হয়েছেন। স্ত্রীর সংসদ সদস্য স্টিকারযুক্ত গাড়ি ব্যবহার করেন নিয়মিত বদি।
সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে তার অনুসারী চেয়ারম্যান প্রার্থীকে জয়ী করতে মাঠে নেমেছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল আলমকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার অভিযোগ ওঠার পর আবারও আলোচনায় এসেছেন বদি।
স্থানীয় লোকজন জানান, এলাকায় দিব্যি শোডাউন করে যাচ্ছেন আবদুর রহমান বদি। বেশিরভাগ অনুষ্ঠানে ‘এমপি’র পরিবর্তে তিনিই উপস্থিত থাকেন প্রধান অতিথি হিসেবে। এমনকি সরকারের যেকোনো অনুষ্ঠানে নিয়মিত থাকেন তিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর নামে নিজের প্রভাব খাটান বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন কার্যত তার ইশারায় চলছে টেকনাফ ও উখিয়ার প্রশাসন। তিনি কক্সবাজারও নিয়ন্ত্রণ করেন বলে এলাকায় রটনা আছে। টেকনাফে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া ৪০০টি ফিশিং ট্রলারে ডিভাইস (জিএসএম) বসানোর কাজের উদ্বোধনও করেন বদি। উদ্বোধনের দিন সংসদ সদস্য অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন না। পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়ায় তার বাড়ির পাশে সরকারের স্থাপনাগুলো নির্মাণ করছেন কৌশলে। নিজের জমি দান করার কথা বলে ওইসব স্থানে সরকারি স্থাপনা তৈরি করছেন। ইতিমধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মডেল মসজিদ ও ভূমি অফিস হয়েছে সেখানে। টেকনাফ পৌরভবন নেওয়ার চেষ্টা করছেন জালিয়াপাড়ায়। বর্তমান পৌর মেয়র মোহাম্মদ ইসলাম তার আপন চাচা। সম্প্রতি টেকনাফ ও উখিয়ায় সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
কিছুদিন আগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বদির আপন দুই ভাই মাদক কারবারে জড়িত।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গুলির ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ছাত্রলীগের এক নেতাকে আটকে রাখা হয়েছিল। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল আলমকে লক্ষ্য করে গুলি করার মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে আমাকে।’
তিনি বলেন, ‘আমি কি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যে আমি নিয়ন্ত্রণ করব, এটা সংসদীয় আসন। আমার স্ত্রী সংসদ সদস্য। তার কাজ আমি কীভাবে করব?’ মাদক কারবারের অভিযোগ বিষয়ে বদি বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি আমার বিরুদ্ধে এগুলো মিথ্যা প্রচার। আমি বা আমার পরিবারের সদস্য কেউ মাদক কারবারে জড়িত নয়। আমার বিরোধী পক্ষের লোকজন এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুর রহমান বদি। একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বদির পরিবর্তে তার স্ত্রী শাহীন আক্তারকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বৃহস্পতিবার রাতে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যাং ইউনিয়নের পশ্চিম মহেশখালীয়া গ্রামে উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও আসন্ন নির্বাচনে একই পদে প্রার্থী নুরুল আলমকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই সময় গুলি করার ঘটনা ঘটে। তবে লিখিত অভিযোগে গুলি করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানায়, কক্সবাজার ও মহেশখালীতে জলদস্যু এবং মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণের পর কিছুদিন প্রায় বন্ধ ছিল তাদের তৎপরতা। পুলিশ ও র্যাবের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। ওইসব অভিযানে তালিকাভুক্ত বড় কারবারিরা যদিও ধরা পড়েনি। ওই ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণের পর বছর দেড়েক কারাগারে ছিল। পরে তারা জামিনে বের হয়ে আসে। এলাকায় জনশ্রুতি আছে, তারা বদির অনুসারী। তার আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েই তারা বেপরোয়া ছিল। বদির বিরুদ্ধে মাদক কারবারসহ নানা অভিযোগ ওঠে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকেই। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদক কারবারিদের তালিকায় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বদির নাম উঠে আসে। ওই তালিকায় তার ভাইসহ পরিবারের ২৬ জনের নাম রয়েছে। স্থানীয় পুলিশের তালিকা অনুযায়ী, বদির ভাই আবদুস শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান, ভাগ্নে সাহেদ রহমান নিপু, সাহেদ কামাল, মোহাম্মদ রাসেলসহ কয়েকজন স্বজন মাদক কারবারে জড়িত। এ ছাড়া দিদার মিয়া, নুরুল হুদা মেম্বারসহ আরও অনেক অনুসারী রয়েছে তার।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, কক্সবাজার ও টেকনাফে বদির ইশারা ছাড়া কিছু হয় না। স্ত্রী শাহীন আক্তার সংসদ সদস্য হওয়ায় তার প্রভাব খাটান তিনি। বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের মধ্যমণি থাকেন এমপির পরিবর্তে বদি। গত পাঁচ বছরে উপজেলায় যেসব বৈঠক হয়েছে তাতে বড়জোর ১-১৫ বার উপস্থিত ছিলেন এমপি। বছর দেড়েক আগে টেকনাফে সরকারি অনুদান হিসেবে ৪০০ নৌযানের মাঝিকে নদীতে অবস্থান করার সময় ব্যবহারের জন্য ডিভাইস দেওয়া হয়। ওই সময় জাঁকজমক অনুষ্ঠান করা হলেও তাতে ছিলেন না এমপি। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বদি। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনাও হয় এলাকায়।
এলাকাবাসী মনে করেন, টেকনাফ-উখিয়া সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য রয়েছেন শুধুই কাগজে-কলমে, ‘ছায়া এমপি’ হয়ে সবই করছেন বদি। তারা জানান, শাহীন আক্তার ঢাকাতেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক কর্মসূচি, সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও যান না এলাকায়। জেলা ও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকেও থাকেন অনুপস্থিত। কোনো কাজে সংসদ সদস্যকে প্রয়োজন হলে স্থানীয়রা যান বদির কাছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আলমকে জয়ী করতে সরকারের অনুদানগুলো স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার ও কাউন্সিলরদের দিয়ে ভোট চাচ্ছেন।
মাদক কারবারের বিষয়ে পুলিশ ও র্যাবের দুই কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল করিমের (পরে ক্রসফায়ারে নিহত) জবানবন্দিতেও সাবেক এমপি বদিসহ অনেকের নাম এসেছিল। জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও সাংবাদিকদের নামও ছিল। মাঝে একসময় বদির সঙ্গে সাইফুল করিমের বিরোধ দেখা দিলে এক পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে বিরোধ মিটে যায়। কক্সবাজারের এক সাবেক পুলিশ সুপার ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের এক সাবেক ডিআইজি, কক্সবাজার সদরের সাবেক এক ওসি, টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহম্মেদ, মনিরুজ্জামান ও তার ভাই আব্দুর গফুর, মৌলভী মজিবুর রহমান, হুন্ডি শওকত এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের কিছু নেতাকে সহায়তা করেন তিনি। কিছু সাংবাদিককেও তিনি নিয়মিত মাসোহারা দিতেন বলে তারা তথ্য পেয়েছেন।
সম্প্রতি উখিয়া ও টেকনাফে গেলে এলাকাবাসী জানান, ‘সংসদ সদস্য না হলেও আব্দুর রহমান বদির ইশারায় সবকিছু চলে। বছর দেড়েক আগে টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় জেলা নেতাদের উপস্থিতিতে পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মো. ইউসুফ মনো ও যুগ্ম সম্পাদক ইউসুফ ভুট্টোকে ব্যাপক মারধর করেন বদি ও তার ভাই আবদুস শুক্কুর। বদির কথার বিরোধিতা করায় তাদের মারধর করা হয়। মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। মারধরের শিকার ইউসুফ মনো বদির আপন মামাতো ভাই।’ মনো দাবি করেন, ‘বর্ধিত সভা চলাকালে বদি পৌর কমিটিকে ডিঙ্গিয়ে বারবার ওয়ার্ড কমিটিকে প্রাধান্য দিয়ে কথা বলছিলেন। পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে আমি তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করায় বাকবিত-ার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বদি মঞ্চ থেকে নেমে তার ক্যাডার বাহিনীকে ডেকে এনে আমাকে কিল-ঘুসি মারতে থাকেন। আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে ইউসুফ ভুট্টোকেও একইভাবে মারধর করেন বদি ও তার লোকজন।’
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নুরুল বশর জানিয়েছেন, এমপি শাহীন আক্তার উখিয়া-টেকনাফে দলের কোনো কর্মসূচিতেও অংশ নেন না। দলের সংসদ সদস্য হিসেবে নেতাকর্মীদের কাছে তার অনেক দায়িত্ব রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফ এলাকার দুজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, টেকনাফ-উখিয়ার পুরো নিয়ন্ত্রণ এখনো বদির হাতে। এমনভাবে তিনি চলাফেরা করেন দেখলে মনে হবে তিনি কোনো কিছুর সঙ্গে নেই। অথচ পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রশাসনের লোক সবার সঙ্গে আছে তার সুসম্পর্ক। ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে আছেন ফরিদ আলম, উসমান গণি, ওমর ফারুক, বাহারছড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ, বিগত বিএনপি সরকারের সময়ের পৌর বিএনপির সভাপতি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ ও তার ছেলে দিদার হোসেন, সাবেক টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজান মিয়া, সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য সামশুল আলম, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ছৈয়দ আলম, ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জামাল হোছেন, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আলী, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও কক্সবাজার জেলা জামায়াতের আমির নুর আহম্মদ আনোয়ারীসহ বেশ কয়েকজন। তাদের বিরুদ্ধ হুন্ডি ব্যবসা, মাদকের কারবারের অভিযোগ এবং দুদকের মামলা রয়েছে।
তারা বলেন, টেকনাফ স্থলবন্দর বদি ও তার লোকজন নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের হয়ে মাঝি আজগর, মো. করিম, মিয়ানমারের নাগরিক মো. আলম ও ফয়েজ উল্লাহ মাঝি টাকা তোলেন। তারা তিন ক্যাটাগরিতে শ্রমিকের নাম দিয়ে টাকা তোলেন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। বদির ভাগ্নে নুর মোহাম্মদ সব কলকাঠি নাড়েন।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ বলেন, ‘আমি আব্দুর রহমান বদিকে সবধরনের সহযোগিতা করি। কারণ তিনি একজন রাজনীতিক এবং সাবেক জনপ্রতিনিধি। তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন। একটি মহল তাকে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করেছে এবং করছে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। মাদকের কারবারির তালিকায় তার নাম থাকলেও তদন্তে তিনি নির্দোষী প্রমাণিত হয়েছেন।’
কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এমপি না হওয়ার পরও বদির কথা আমাদের শুনতে হয়। তার স্ত্রী বর্তমান এমপি। দুজনই খুব প্রভাবশালী। যেসব মাদক কারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, তাদের প্রায় সবাই বদির অনুসারী। তার প্রভাব এখনো বর্তমান। তবে আমরা কোনো অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত দিই না।’
তিনি আরও বলেন, সংসদ সদস্যের স্টিকারযুক্ত সাদা রঙের প্রাডো গাড়ি ব্যবহার করেন বদি। এমনকি লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্র রাখেন গাড়িতে। গাড়িতে অবৈধ জিনিসপত্র থাকলেও তল্লাশি করার সুযোগ নেই তাদের।
সুত্র: দেশ রুপান্তর