বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়মিতই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সক্ষমতা ব্যবহার হবে, এমন শর্তে লাইসেন্স দেয়া হলেও এসব কেন্দ্র চলছে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। এতে বসিয়ে রেখেই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। তবে এ থেকে সহজে মুক্তি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। বেসরকারি খাতে নতুন করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি না দিলেও আরও ২৭ থেকে ২৮ বছর টানতে হবে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা।
বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে জানতে চায় আইএমএফের প্রতিনিধিদল। বৈঠকে ক্যাপাসিটি চার্জের স্ট্যাটাস জানতে চায় আইএমএফের দলটি। এ সময় পিডিবি জানায়, গ্যাস ও তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট সক্ষমতার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১০ থেকে ১২ ডলার। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে এ চার্জ ২০ থেকে ২৫ ডলার।
এ হিসাবে গ্যাস বা জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত সক্ষমতার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গচ্চা দিতে হয় বছরে ১২ থেকে সাড়ে ১৪ কোটি ডলার। বিদ্যমান বিনিময় হারে এর পরিমাণ এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত সক্ষমতার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গচ্চা দিতে হয় বছরে ২৪ থেকে ৩০ কোটি ডলার। বিদ্যমান বিনিময় হারে এর পরিমাণ দুই হাজার ৮০০ থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।
সক্ষমতার অতিরিক্ত বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকছে। এতে পিডিবির স্থায়ী ব্যয় তথা লোকসান ও সরকারের ভর্তুকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর আগে ঋণ অনুমোদনের আগে ২০২২ সালের নভেম্বরে বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির সঙ্গে বৈঠকে করেছিল আইএমএফ প্রতিনিধিদল। ওই সময় তাদের প্রশ্ন ছিলÑএখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে, সেটি ২০৩০ সালে শেষ হবে কি না? তখন পিডিবি জানায়, ‘সেটি সম্ভব নয়, কারণ নতুন নতুন বেশকিছু আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) উৎপাদনে আসছে। তাদেরও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। এখন পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে, কবে নাগাদ ক্যাপাসিটি চার্জ শেষ করা যাবে।’
আইএমএফের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান ও পাইপলাইনে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে শেয়ার বিজ। এতে দেখা যায়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ ২৫ বছর। এ তালিকায় রয়েছে ভারতের আদানি, দেশীয় এসএস পাওয়ার, চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের পায়রা, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের রামপালসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্র। গ্যাস বা এলএনজিভিত্তিক কেন্দ্রের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২২ বছর। এ তালিকায় আছে ভারতের রিলায়েন্স, দেশীয় সামিট, ইউনাইটেডসহ আটটি কেন্দ্র। এর মধ্যে দুটি কেন্দ্র দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক তথা এলএনজি/ডিজেলচালিত। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ ১৫ বছর। এছাড়া বেশকিছু সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র পাইপলাইনে আছে। তবে এগুলোর জন্য কোনো ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে না।
তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর ১৫ বছরের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৭৮৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৩৩৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ৬৩ হাজার ৪৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
প্রতি বছরই বাড়ছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরিমাণ। গত অর্থবছর এ খাতে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এ খাতে ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর মূল কারণ আদানি, সামিট ও এসএস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র। আগামী কয়েক বছর এ খাতে ব্যয় বাড়বে। কারণ বড় আকারের বেশকিছু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের আগামী দুই বছরের মধ্যে উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে।
তথ্যমতে, গত বছর উৎপাদনে এসেছে ভারতের আদানি, বাংলাদেশের এসএস পাওয়ার ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাচালিত এ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে ২০৪৮ ও ২০৪৯ সালে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ২০৪৬ সাল পর্যন্ত।
পটুয়াখালীতে আরও দুটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে এ কেন্দ্র দুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে পটুয়াখালী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে, যার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ২০৪৯ সাল পর্যন্ত। পটুয়াখালীর পায়রা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ২০২৬ সালের এপ্রিলে উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। এ কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ২০৫১ সাল পর্যন্ত।
ভারতের রিলায়েন্স, বাংলাদেশের সামিট ও ইউনিট গ্রুপ তিনটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এর মধ্যে সামিটের কেন্দ্রটি দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে এ তিনটি কেন্দ্রের উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে, যার ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ২২ বছর তথা ২০৪৬ থেকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত। আর ইউনাইটেড পাওয়ারের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ২০২৬ সালে উৎপাদন শুরুর কথা। এর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ২০৪৮ সাল পর্যন্ত।
২০২৬ সালেই উৎপাদন শুরুর কথা আনলিমা গ্রুপের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের। একই সময় গজারিয়ায় আরেকটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। আর কনফিডেন্স গ্রুপের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালে। এ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে যথাক্রমে ২০৪৮ ও ২০৪৯ সাল পর্যন্ত। সুত্র: শেয়ারবিজ