নিখোঁজদের তালিকায় সবশেষ যাদের নাম জানা গেছে তাদের পাঁচ জনই একই পরিবারের সদস্য। এই পরিবারটিও আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল। পরিবার প্রধান রোকন উদ্দিন ছিলেন শিশু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তার স্ত্রী নাঈমা আক্তার সরকারি কবি নজরুল কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছে, এখন পর্যন্ত তারা যে তথ্য পেয়েছেন তাতে তাদের ধারণা, এই পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য উগ্রবাদে জড়িয়ে গেছেন এবং পরে তিনি অন্য স্বজনদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার তথ্য থাকলেও এদের বর্তমান অবস্থান জানে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার ৪২২/বি নম্বর বাড়িতে থাকতো পরিবারটি। ওই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক হেলাল উদ্দিন জানান, রোজার শুরুর দিকে সপরিবারে মালয়েশিয়া যান রোকন উদ্দিন। যাওয়ার সময় তিনি বলে গেছেন, কোনো মুসলিম দেশ ভালো লেগে গেলে সেখানেই থেকে যাবেন। আর দেশে ফিরবেন না। তবে মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে রোকন উদ্দিন চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশ কিছু মানুষের উধাও হয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। আর অভিভাবকদের নামে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে গণমাধ্যমে প্রথমে ১০ জনের নামে যে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয় তাদের মধ্যে তিন জনের পরিবারের সদস্যদেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
এর আগে ২০১৫ সালে ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একটি পরিবারের সব সদস্য জঙ্গি সংগঠন আইএসে যোগ দিতে মধ্যপ্রাচ্যে চলে গিয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও এলাকায়।
গত বছর ১০ এপ্রিল পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটি কাটাতে বাংলাদেশ আসে ব্রিটেনের ১২ সদস্যের একটি পরিবার। পরিবারের দুই ছেলে ও তিন মেয়েই উগ্রবাদে জড়িয়ে গিয়েছিল বলে জানতে পেরেছে ব্রিটিশ পুলিশ। ১১ মে যুক্তরাজ্যে ফেরার জন্য তারা তুরস্কেও ইস্তানবুল বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর ১৪ মে যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছার কথা থাকলেও তারা সেখানে যাননি। পরে জানা যায়, গোটা পরিবারই তুরস্ক হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পারি জমিয়েছে।
চাকরি ছেড়ে বিদেশ পারি জমান চিকিৎসক রোকনউদ্দিন
ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্ট্রারও ছিলেন রোকন উদ্দিন। তার হঠাৎ বিদেশ চলে যাওয়ার কথা জানতেন সহকর্মীরাও। তবে তিনি কোনও ধরনের উগ্রবাদে জড়িত থাকতে পারেন-এমন ধারণাও করতে পারেননি তারা।
শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক রেজোয়ানা রিমা বলেন, ‘ওনার (রোকন উদ্দিন) আচার আচরণ বরাবই ছিল ভদ্র। তাকে আমরা সবাই পছন্দ করতাম। চাকরি ছেড়ে তিনি বিদেশ চলে গেছেন, কেবল এটা জানি। কিন্তু কোথায় গেছেন, কী করছেন, সে বিষয়ে কোনও ধারণা নেই’।
হাসপাতালের অন্য একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রোকন উদ্দিন আগে খুব একটা ধার্মিক ছিলেন না। কিন্তু সম্প্রতি তিনি ধর্ম-কর্মে ঝুঁকেন, দাড়িও রাখেন’।
আর তার স্ত্রী উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাঈমা আক্তার ২০১২ সাল পর্যন্ত ঢাকার সরকারি কবি নজরুল কলেজে পড়াতেন বলে জানিয়েছেন কলেজের অধ্যাপক নওশের আলী। তিনি বলেন, ‘আমি এই কলেজে নাঈমা আপাকে এক বছর দেখেছি। তখন তো মনে হয়নি তিনি কোনও ধরনের উগ্রবাদে জড়িত থাকতে পারেন। খবরটি জানার পর আমরা শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা করেছি। সবাই অবাক হয়েছেন, বিষ্মিত হয়েছেন’।
কবি নজরুল কলেজের পর নাঈমা আক্তার চাকরি করেন যশোরের এম এম কলেজে। এই প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান জানান, গত বছরের জুলাই মাসে স্পেন ও জার্মানি যাওয়ার কথা বলে ছুটি চান নাঈমা। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে ৪৬ দিনের ছুটি দেন। ছুটি শেষে আগস্টে যোগ দেয়ার কথা থাকলেও নাঈমা আর কলেজে যাননি।
নাঈমার সপরিবারে উগ্রবাদী সংগঠনে যোগ দেয়ার বিষয়ে এম এম কলেজেও আলোচনা আছে বলে জানিয়েছেন অন্য একজন শিক্ষক। কেবল নাঈমা নন তার বড় মেয়ে ও মেয়ের জামাইও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়েছেন-এমন কথাও জেনেছেন তারা।
নিখোঁজদের দুই জন নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী
পুলিশ জানিয়েছে, চিকিৎসক রোকন উদ্দিনের মেয়ে এবং মেয়ের জামাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথে পড়তেন। এর মধ্যে বড় মেয়ে নাদিয়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। তার স্বামী শিশিরও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের ছাত্র ছিলেন। আর ছোট মেয়ে রামিতা রোকন ভিকারুন নিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী।
সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতায় ঘুরে ফিরে নাম এসেছে উচ্চবিত্ত শ্রেণির পছন্দ এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি নর্থ সাউথের নাম। হলি আর্টিজান এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলাকারীদের দুই জন ছিলেন এই বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান বা সাবেক শিক্ষার্থী। জঙ্গি তৎপরতায় জড়াতে আত্মগোপনে আছেন, এমন বেশ কয়েকজনও এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষকও উগ্রবাদে জড়িত বলে বিভিন্ন সময় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়টির ৪০ জন শিক্ষার্থীর বিষয়ে তথ্যও চেয়েছে শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য আতিকুল ইসলাম তার প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও সাবেক বেশ কিছু শিক্ষার্থীর কর্মকাণ্ডকে ক্যান্সার হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং এই ক্যান্সার অপারেশন করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
সোমবার রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি তার নিখোঁজদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে এ ব্যাপারে থানায় কোনো জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
জানতে চাইলে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই পরিবারটির মালয়েশিয়া চলে যাওয়া ছাড়া আপাতত আমার কাছে কোনও তথ্য নেই’।-ঢাকাটাইমস