রেজাউল করিম চৌধুরী:
ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ফোরাম (সিডিএফ) একটি গবেষণায় দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো সরাসরি ৩ কোটি পরিবারকে সহায়তা করে, আর এই কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত আছে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কর্মী। দেশের জিডিপিতে ক্ষুদ্রঋণের অবদান ১২% । গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্ষুদ্রঋণ সেবাদানকারী এনজিওগুলোর সম্মিলিত ঘুর্ণায়মান তহবিলের পরিমাণ প্রায় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা, যা দেশের বার্ষিক বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ।
উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষুদ্রঋণ সেবাদানকারী একটি মাঝারি আকারের সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট, সংস্থাটির ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা (মূলত দরিদ্র পরিবারের সদস্য) তাঁদের বতর্মান দুর্দশার কথা জানিয়ে প্রতিনিয়ত ফোন করছে, এবং ঋণ বা সঞ্চয় ফেরতের জন্য অনুরোধ করছে। কিন্তু কবে-কখন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি পুনরায় চালু করা যাবে, এ বিষয়ে সংস্থাটির কাছে কোনও তথ্য নেই!
কুতুবদিয়ার ক্ষুদ্রঋণ সেবাদানকারী একটি প্রতিষ্ঠানের একজন দরিদ্র সদস্যকে ২০২০ সালের ৪ মে একজন দাঁদন ব্যবসায়ী হত্যা করে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুন হওয়া সদস্যটির পরিবারকে খুব উচ্চ সুদে ৫০০০ টাকা ঋণ নিতে হয়েছিলো, এর সুদ ছিলো প্রতিমাসে ৫০০ টাকা, সুদের হার প্রায় ৩০০%। অর্থ পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে তীব্র তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে দাঁদন ব্যবসায়ী তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে। দুর্ভাগ্যক্রমে, উক্ত ঋণগ্রহীতা লকডাউনের কারণে সৃষ্ট তার দুর্ভোগের কারণে অর্থ পরিশোধে অক্ষম ছিল।
জীবিকা নিশ্চিত করার জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের এই লকডাউন অবস্থাতেও অর্থের প্রয়োজন। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতিতে, দাঁদন ব্যবসায়ীরা মানুষের প্রয়োজনকে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে। এসব দাঁদন ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার কোনও ব্যবস্থা নেই, কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ সরকারের অধীনে এমআরএ (মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
গ্রামীণ এবং শহর উভয় অঞ্চলের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলি এই লকডাউন পরিস্থিতিতে স্বল্পমাত্রার বিনিয়োগ এবং জীবিকার প্রয়োজন মেটাতে দরকারি অর্থ পাচ্ছে না। উল্লেখ্য যে, ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর ৩০% ঋণ সাধারণত গ্রহীতার জীবিকার চাহিদা পূরণে ব্যয় হয়। এনজিও – ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও করতে পারে। কারণ তারা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছে. তেমনি বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলায়ও অসামান্য অবদান রেখে চলছে। বাংলাদেশের এনজিওদের দুটি বড় নেটওয়ার্ক এডাব এবং এফএনবি’র দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে প্রায় ২০০ এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা করোনা বিরোধেী সচেতনতা, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ত্রাণ কার্যক্রমে অবদান রাখছে। তারা তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো কোয়ারেন্টিনের জন্য ছেড়ে দিয়েছে এবং তাদের হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এই অবদানগুলোর আর্থিকমূল্য প্রায় ১১৭ কোটি টাকারও বেশি।
লকডাউনের কারণে অনেক চেষ্টার পরেও এনজিও-ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো কর্মীদের পুরো বেতন পরিশোধ করাসহ বিভিন্ন সমস্যায় ইতিমধ্যে পড়ে গেছে। কারণ তারা কখনো নগদ টাকা জমা রাখে না । একটি পর্যালোচনা থেকে দেখা গেছে যে, এরকম পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ১ থেকে ৫টি শাখা আছে এমন প্রায় ৬৩০টি ছোট আকারের এবং স্থানীয় বেসরকারী এনজিও-ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা বিলুপ্ত হতে পারে। এটি হলে এই খাতে একটি অপ্রত্যাশিত ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়ে যেতে পারে।
এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো অতি দ্রুত তাদের নিজস্ব সম্পদ নিয়েই বর্তমান বৈশ্বিক মহামারী প্রতিরোধে ঝাপিয়ে পড়ে, তারা যাদের জন্য কাজ করে তাদের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকেই তারা করোনা প্রতিরোধমূলক ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে। দুর্ভাগ্যক্রমে, লকডাউন হঠাৎ তাদের এই সচেতনতামূলক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে। কোস্ট ট্রাস্টের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, উপকূলীয় এলাকার নিম্ন আয়ের ৪৯% মানুষ নতুন স্বাস্থ্য আচরণবিধিগুলো বিষয়ে খুব কমই জানেন। কোস্টের মতো, বেশিরভাগ এনজিও- ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলতে ইতিমধ্যে তাদের আচরণবিধি এবং জৈব সুরক্ষা বিধিগুলিকে সংশোধন করেছে এবং মহামারী সম্পর্কিত স্বাস্থ্য ও মানসিক বিষয়ে তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তারা সতর্কতা হিসেবে সদস্যদেরকে শারীরিক দূরত্ব বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান, অফিস জীবানুমুক্তরণ এবং ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে সবাইকে পরীক্ষা করার মতো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব বিষয়ে কোস্ট ট্রাস্টের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে www.coastbd.net এ জানা যাবে এবং ডাউনলোড করা যেতে পারে । এনজিও-ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে “গোটুমেটিং” এবং “জুম” এর মতো সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানরত তাদের কর্মীদের সাথে নিয়মিত ভার্চুয়াল সভা করছে।
সিডিএফ এবং পিকেএসএফ (পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন) এই এনজিও -ক্ষুদ্রঋণ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বর্তমানে নীতি সহায়তা লাভের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। তৃতীয় প্রজন্মের প্রায় ২৫০টি এনজিও- ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা পিকেএসএফের সহায়তায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উদ্যোক্তা বিকাশ, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সরকারগুলিকে সহায়তা প্রদানসহ সদস্য-অংশগ্রহণকারীদের জন্য অন্যান্য অধিকারভিত্তিক পরিষেবা সমৃদ্ধ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা- সহায়তা দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ তাদের লক্ষ্য। আর এই নতুন ধারণাটির নেতৃত্বে আছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জামান, যিনি পিকেএসএফের বর্তমান চেয়ারপারসন।
ভারত সরকার ব্যাংকগুলির পাশপাশি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকেও লকডাউনের সময় কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। তারা “বন্ধন” নামের একটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে দরিদ্রদের জন্য এবং ছোট ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোর জন্য ৫০ হাজার কোটি রুপি বিতরণ করছে।
বাংলাদেশী এনজিও-ক্ষুদ্রঋণ সেবাদানকারী সংস্থাগুলো দাতাদের অর্থের উপর নির্ভরশীল নয়, যা তাদের স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভের শক্তি । আমরা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে সহমর্মিতা-সহানুভুতি প্রত্যাশা করি, কারণ এই সংস্থাগুলো আপনাদের গর্ব এবং আপনাদেরই প্রতিষ্ঠান।
রেজাউল করিম চৌধুরী
নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট।
পাঠকের মতামত