ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের কবজায় যে ব্যাংকগুলো ছিল সেগুলো ছাড়াও অন্তত ১১টি ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট বেশি দেখা দিয়েছে। নিজের জমানো টাকা তুলতে গেলেও গ্রাহকদের এসব ব্যাংক থেকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। শুধু যে নগদ টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সংকট হচ্ছে তা নয়-আরটিজিএস এবং বিএফটিএনের মাধ্যমে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা দিচ্ছে টাকার অভাবে।
গ্রাহককে চাহিদা মাফিক টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে এই ব্যাংকগুলো। গ্রাহকরা এক ব্রাঞ্চ থেকে আরেক ব্রাঞ্চে দৌড়ালেও টাকা তুলতে পারছেন না। ক্ষুব্ধ হয়ে ঢাকাসহ দেশে বিভিন্ন জেলায় ওই ব্যাংকগুলোর ব্রাঞ্চে তালা ঝোলাচ্ছেন গ্রাহকরা। আবার টাকা না পেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডাতেও জড়াচ্ছেন গ্রাহকরা।
নগদ টাকার এই সংকট বেশি দেখা দিয়েছে মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ১১ ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে সেগুলোতে। এর মধ্যে ৮টিই ছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের কবজায়। এই ব্যাংকগুলো ইসলামী ধারার ব্যাংক হওয়ায় সংকটটি আরও বেশি দেখা দিয়েছে। কারণ ব্যাংকগুলো অন্য সবল ব্যাংকের সঙ্গে কলমানিতে যেতে পারছে না। এ অবস্থায় সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো নিজস্ব পন্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর বা সংকট দূর করার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন পন্থায় ঋণ আদায় বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ বা নতুন ঋণ দেওয়া কমিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে ডিপোজিট বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে সংকটে থাকা এক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, ‘যে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে এখন, সেটি কেন হয়েছে তা সবারই জানা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে তারল্য সংকট এতটাই প্রকট হয়েছে যে আমরা নিজেরাও নিজেদের বেতনের টাকাও তুলতে পারছি না। গ্রাহকদের টাকা তো দেওয়াই যাচ্ছে না। তারল্য সংকট দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে অর্থ দিয়েছে তা চাহিদার তুলানায় খুবই কম। দেখা যাচ্ছে আমাদের ব্যাংক এখন দরকার ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু আমরা তারল্য সাপোর্ট পেয়েছি মাত্র ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মতো সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো এখন নিজ উদ্যোগে তারল্য সংকট দূর করতে এবং চলমান সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এ জন্য আমরা নানা কৌশলে ঋণ আদায় বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এ ক্ষেত্রে যারা ঋণখেলাপি তাদের বাড়ির সামনে গিয়ে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানোর পরিকল্পনাও করছি আমরা।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা সময়ের আলোকে বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত যে ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতেই মূলত তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে বেশি। এর মধ্যে ৭টি ব্যাংককে ইতিমধ্যে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা তারল্য সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আরও কীভাবে ব্যাংকগুলোকে সহযোগিতা করা যায় সে চিন্তাও রয়েছে কেন্দ্রীয় বাংকের।’
নিজের টাকা তুলতে গিয়ে কী ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তার বর্ণনা দিলেন সিরাজুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংকে।
সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ‘বাড়ি ভাড়া, সন্তানের শিক্ষা খরচ, সংসারের জন্য বাজার-সদাই কেনা-এ রকম জরুরি প্রয়োজনে প্রতি মাসের শুরুতেই মোটা অঙ্কের টাকার দরকার পড়ে আমার।এসআইবিএলের পল্টন শাখায় আমার অ্যাকাউন্ট রয়েছে, সেখানে বেশ কিছু টাকা রয়েছে আমার। ৫০ হাজার টাকা তুলব বলে চেক নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু ব্রাঞ্চ থেকে আমি টাকা তুলতে পারিনি, কারণ ব্যাংকে টাকা নেই। পরে আমি মতিঝিলসহ আরও কয়েকটি ব্রাঞ্চে ঘুরেও টাকা তুলতে পারিনি। পরের দিন ইসলামী ব্যাংকে আমার স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার জন্য চেক জমা দিলে সেখান থেকেও টাকা তুলতে পারিনি। অথচ টাকা জরুরি দরকার আমার। পরে বাধ্য হয়ে এক বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে প্রয়োজন মিটিয়েছি।’
একজন সিরাজুল ইসলাম নন, তার মতো শত শত গ্রাহককে এখন টাকা তুলতে গিয়ে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ জন্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন ব্যাংকের ব্রাঞ্চে গ্রাহকদের তালা ঝুলিয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে। যেমন গত ২২ অক্টোবর চাঁদপুর শহরের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ফয়সাল শপিং কমপ্লেক্স ভবনের এসআইবিএলের শাখায় চেক দিয়ে টাকা না পাওয়াকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে তালা ঝুলিয়ে দেন বিক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। প্রায় এক ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর পুলিশ এসে তালা খুলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে।
তারও আগে ২২ সেপ্টেম্বর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালীর সোনাপুর শাখা, মাইজদী বাজার শাখাসহ জেলার বিভিন্ন শাখায় তারল্য সংকটের কারণে পর্যাপ্ত টাকা দিতে না পারায় সংকট দেখা দেয়। এখানে এক লাখ টাকার বিপরীতে গ্রাহকদের নতুন আরেকটি চেকে দেওয়া হয় ৫, ১০ কিংবা ১৫ হাজার টাকা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন গ্রাহকরা।
এ ছাড়া গত ৩০ অক্টোবর সিলেটের ন্যাশনাল ব্যাংকে শিবগঞ্জ ব্রাঞ্চে টাকা তুলতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন গ্রাহকরা। সিলেট মহানগরের শিবগঞ্জ এলাকার ন্যাশনাল ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা থাকার পরেও চাহিদা মতো টাকা তুলতে না পারায় মূলত গেটে তালা দেন ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা।
মূলত বিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাত থেকে লুটপাট এবং ব্যাংক থেকে বিভিন্নভাবে বড় অঙ্কের অর্থ যুক্তরাজ্য, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করার কারণে ব্যাংকগুলোর এ দশা হয়েছে। আর এই লুটপাটে নেতৃত্ব দিয়েছে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম। লুটপাটের কারণে দেশের এই ১১ ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারছেন না। এর মধ্যে রয়েছে-ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউসিবি, এক্সিম ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। এর বাইরে আরও তিন ব্যাংকে এই সংকট দেখা দিয়েছে।
তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এক ব্রিফিংয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা টাকা ছাপাব না। তার মানে হচ্ছে, আমরা যদি টাকা ছাপিয়ে সব ব্যাংকের টাকা শোধ করতে যাই তা হলে আমাদের লক্ষ কোটি টাকা ছাপাতে হবে বা আরও বেশি। সেটি কাম্য নয়। যাদের লিকুইডিটি শর্টেজ আছে, ব্যাংকিং খাতের লিকুইডিটি দিয়েই ইনোভেটিভ ওয়েতে তাদের লিকুইডিটি সাপ্লাই করব।’
এ ছাড়া ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর বলেছিলেন, ‘ব্যাংক খাত থেকে বিভিন্নভাবে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে গেছে। মূলত সাত-আটটি ব্যাংক থেকে এই অর্থ বের হয়েছে। এসব ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। আমরা আগের মতো টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংকে দেব না। এটি করতে হলে দুই লাখ কোটি টাকা ছাপাতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম-সবকিছু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যাবে। আমরা তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে সীমিত আকারে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এসব ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংক থেকে টাকা আমানত হিসেবে পাবে, এতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি) দেবে।’
এদিকে অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সময়ের আলোকে বলেন, ‘লুটপাটের কারণেই ব্যাংকগুলোর এই দৈন্যদশা, সংকট সহসাই কাটবে না। তবুও কীভাবে ব্যাংকগুলোকে ভালো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। সূত্র সময়ের আলো