চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরকালীন অবকাঠামো চুক্তির আওতায় চট্টগ্রামে দেশের একমাত্র এবং বহু প্রতীক্ষিত কর্ণফুলী টানেল এবং বিনিয়োগের আওতায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার চুক্তি হবে। আজ শুক্রবার বিকেলে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্টের যৌথভাবে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে এ দুটি প্রকল্পের উদ্বোধন করার কথা।
নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদদের আশাবাদ, সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার এই দুই মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে বৃহত্তর চট্টগ্রামে যোগাযোগ, বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। চট্টগ্রাম হবে শিল্পোৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র।
বহু প্রতীক্ষিত কর্ণফুলী টানেল
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে যুক্ত করতে চীনের সঙ্গে গতবছর চুক্তি করে সরকার। চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার চিন্তা থেকেই কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু প্রতীক্ষিত টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জিটুজি ভিত্তিতে নদীর তলদেশে এই ‘টানেল’ নির্মাণের কাজ পেয়েছে চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)।
টানেলটি নির্মাণের জন্য ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেইজিংয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। চীন ও হংকংয়ের দুটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই টানেলের এলাইনমেন্ট হবে এয়ারপোর্ট থেকে কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটির দিকে। টানেলের প্রবেশপথ হবে নেভি কলেজের কাছে এবং বহির্গমন পথ হবে সার কারখানার কাছে।
টানেল নির্মাণ করা হবে ‘শিল্ড ড্রাইভেন মেথড’ পদ্ধতিতে। মোট দৈর্ঘ্য হবে তিন হাজার ৪০০ মিটার। এছাড়া টানেলের পশ্চিম প্রান্তের প্রপ্রোচ রোডের দৈর্ঘ্য হবে ৭৪০ মিটার, পূর্বে চার হাজার ৯৫২ মিটার।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প সূত্র জানায়, আজ শুক্রবার উদ্বোধনের পরই টানেল নির্মাণকাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে নির্মাণকাজের ডাম্প ট্রাক, এস্কেভেটরসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম চট্টগ্রামে পৌঁছে গেছে। যমুনা সেতু মেরামতের সময় যেসব উপকরণ আনা হয়েছিল সেগুলোও টানেল নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হবে। আগামী ডিসেম্বরে পুরোদমে টানেলের কাজ শুরু হবে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের মাধ্যমে কর্ণফুলীর অন্য পাড় দক্ষিণ চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম মহানগরীর চেয়ে বড় একটি শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনায় চট্টগ্রামের সঙ্গে মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টি চিন্তায় নিয়ে টানেল নির্মাণের প্রকল্প নেয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালের মধ্যে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণকাজ শেষ করার কথা রয়েছে। টানেলটির মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে হয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে, এমনই পরিকল্পনা সরকারের।
প্রসঙ্গতঃ টানেল নির্মাণের ক্ষেত্রে ৫টি শর্ত দিয়েছিল চীন। এই শর্ত কমাতে ৮ সদস্যের নেগোসিয়েশন টিম গঠন করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। গত ২৯ সেপ্টেম্বর চীনের এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে এই টিম।
ব্যাপক আলোচনার পর শুধুমাত্র ম্যানেজমেন্ট ফি শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ করেছে। অন্য শর্তগুলো চেষ্টার পরেও কমানো যায়নি। চীনের দেয়া শর্তগুলো হচ্ছে-সুদের হার ২ শতাংশ, ঋণ পরিশোধের সময় ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছর, ম্যানেজমেন্ট ফি শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ, কমিটমেন্ট ফি শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ এবং চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ম্যানেজমেন্ট ফি বাবদ ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার দিতে হবে।
টানেলের সুপারিশে বলা হয়, নদীর তলদেশে টানেল হবে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। পূর্ব প্রান্তের ৪ দশমিক ৯৫২ কিলোমিটার ও পশ্চিম প্রান্তে ৭৪০ মিটার সংযোগ সড়কসহ টানেলের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৯ দশমিক ০৯২ কিলোমিটার। এ ছাড়া টোল বুথ ও টোল প্লাজা নির্মাণ করা হবে ৭২০০ বর্গমিটার। চার লেনের টানেলে উভয়পাশে দুটি টিউব থাকবে। প্রতিটি টিউবের ব্যস হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার। এর অবস্থান হবে নদীর তলদেশের ১২ থেকে ৩৬ মিটার গভীরে। টানেলের ভিতরে যানবাহন ছাড়া মানুষ চলাচলের কোনো সুযোগ থাকবে না। প্রথম পর্যায়ে শহর অংশের কাজ শেষ করে পরে নির্মাণ হবে বাকি অংশের কাজ। টানেল ও এপ্রোচ রোডসহ প্রকল্পটির জন্য ব্যয় হবে ৮ হাজার ৪শ কোটি টাকা; যার মধ্যে ৫ হাজার ৬শ কোটি দেবে চীনের এক্সিম ব্যাংক। বাকি অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ সরকার।
আনোয়ারার চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলঃ শতভাগ চীনা বিনিয়োগের এই অঞ্চলটি হবে দেশের প্রথম জিটুজি (বাংলাদেশ ও চীন সরকার) অর্থনৈতিক অঞ্চল। এতে চীন সরকারের ৩০ শতাংশ আর চীনা বিনিয়োগকারীদের ৭০ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকবে। চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এই মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে তৈরি পোশাক, রাসায়নিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, টেলিযোগাযোগ, কৃষিনির্ভর শিল্প কারখানা, যন্ত্রপাতি, ইলেক্ট্রনিকস, টেলিভিশন, মনিটর, চিকিৎসা ও অপারেশনের যন্ত্র, প্লাস্টিক, আইটি ও আইটি সম্পর্কিত কারখানা গড়ে উঠবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৫৩ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই প্রকল্পে ২৯১ একর খাসজমি ইতিমধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) হস্তান্তর করেছে জেলা প্রশাসন। আরও ৪৮৪ একর জমি অধিগ্রহণের কাজও প্রায় শেষ। অধিগ্রহণের জন্য ৪২০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বেলচূড়া, হাজিগাঁও, বটতলী ও বৈরাগ মৌজায় ২৯০ দশমিক ৮৭৫ একর সরকারি খাসজমি বেজার অনুকূলে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। এছাড়া গহিরায়ও অর্থনৈতিক অঞ্চল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। বেজা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৯ কিলোমিটার, শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার এবং শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরত্বে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ইলেকট্রিক, ফার্নেস ও সিমেন্ট শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে এ বিশেষ অথনৈতিক অঞ্চলটি গড়ে তোলা হবে। এই অর্থনৈতিক জোনের কাজ ২০১৭ থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২০ সালে। এর জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো সুবিধা সম্পন্ন করে বিনিয়োগের উপযোগী করতে আগামী এক বছর সময় লাগবে। আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৩৭১টি শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হবে। এরমধ্যে ২৫০টিই জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বরাদ্দ থাকবে। অবকাঠামো উন্নয়নসহ প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করার জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর জুনে চীন সফরের সময় চীনা প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে এই বিশেষ অর্থনেতিক ও শিল্প অঞ্চল স্থাপনের প্রস্তাব দেন। পরে এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ওই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তের ভিত্তিতে জমি দেবে এবং চীন সরকারের মনোনীত প্রতিষ্ঠান ওই জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলবে। প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, বরাদ্দের ৯২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হবে জমি অধিগ্রহণে। প্রকল্পে সড়কের কাজের সাথে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ প্রদান করা হবে।র্পূবকোন
সড়ক দুর্ঘটনায় চিত্রনায়িকা পরীমণির প্রথম স্বামী ইসমাইল হোসেন জমাদ্দার (৪২) নিহত হয়েছেন। শুক্রবার (২২ নভেম্বর) ...
পাঠকের মতামত