চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন প্রকল্প আলোর মুখ দেখছে। জেগেছে আশার আলো। রেললাইন স্থাপনের জন্য চকরিয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পাবেন কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ভর করেছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চট্টগ্রাম জেলায় ২৮০ একর এবং কক্সবাজারে ৯৯৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এসব জমি অধিগ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দাবি করা ৩৯১ কোটি টাকার মধ্যে ৩১২ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। আর কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহণের জন্য টাকা চেয়েছে ৩১৪ কোটি টাকা।
২০১০ সালের ৬ জুলাই বহুল প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়। এর পরের বছরের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্প উদ্বোধন করেন।
কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল রেল (কেনারাল), স্ম্যক ইন্টারন্যাশনাল পিটিওয়াই লি. অস্ট্রেলিয়া (এসএমইসি), ডিবি ইন্টারন্যাশনাল জিএমএসএইচ জার্মানি এবং এসিই কনসালট্যান্ট লি. নামের চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জরিপ কাজ করে। অনুমোদন দেওয়ার সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি সিদ্ধান্তে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি ও কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালের সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকা বাদ দিয়ে নতুন করে জরিপ কাজ করতে হয়েছে। ওই জরিপ কাজ গত জুলাই মাসে শেষ হয়। এই প্রকল্পের অধীনে দোহাজারী হতে চকরিয়া-রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এবং রামু হতে ঘুনধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারসহ মোট ১২৮ কিলোমিটার নতুন ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পটির সহকারী পরিচালক আবদুল গফুর মজুমদার জানান, ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হলেই রেলপথ এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ দিতে প্রস্তুত আছে এশিয়ান ডেভলেপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। শুরুতে মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন মিটারগেজ নয়, ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ করতে। যাতে সব ধরনের ট্রেন চলাচল করতে পারে। সরকার ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০২১’ এর আওতাভুক্ত ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল কক্সবাজারের ঝিলংজায় প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তার স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রকল্পে যা আছে : দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এবং রামু হাতে ঘুনধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারসহ মোট ১২৮ কিলোমিটার নতুন ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ। পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ের নেটওয়ার্কের আওতায় আনা। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন। সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, কাগজের কাঁচামাল, বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহন এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডর মিসিং লিংক নির্মাণ। দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিমি রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিমি এবং রামু থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত ২৮ কিমি রেলপথ নির্মাণের কথা রয়েছে। আর ১২৮ কিমি রেলপথে স্টেশনের সংখ্যা থাকছে ৯টি। এগুলো হল সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়ার সাহারবিলের রামপুর, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার, উখিয়া ও ঘুনধুম। এতে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম থাকবে ৯টি, ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম থাকবে ৯টি। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর উপর নির্মাণ করা হবে সেতু। এছাড়া ৪৩টি মাইনর সেতু, ২০১টি কালভার্ট, সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় একটি ফ্লাইওভার, ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং এবং রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং নির্মাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রস্তাবিত প্রকল্পে।
চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ভূমি জরিপের সময় চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট এলাকায় মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালের মাঝখান দিয়ে রেললাইন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে বাধ সাধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে চীনের সাথে চুক্তি হলে এডিবি চীনের অর্থায়নে চারটি সংস্থার সমন্বয়ে দ্বিতীয়বার জরিপ করা হয়। ওই জরিপে মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতাল এলাকা রেললাইন থেকে বাদ দিয়ে নকশা পরিবর্তন করা হয়।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাহেদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রেললাইন স্থাপনের বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে রেললাইন কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসন থেকে যখনই জরিপসহ যেকোনো বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা চাওয়া হয়েছে, তখনই সহায়তা দেওয়া হয়।’
তিনি জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ইতোমধ্যে হারবাং ইউনিয়নের বড়ুয়াপাড়া এবং চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়সহ রেললাইনের নকশায় যেসব স্থাপনা পড়েছে তা একাধিকবার পরিদর্শন করেন তিনি। স্থাপনা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকসহ নানা তত্পরতা চলছে। এ সময় বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা তাঁদের স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছেন।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘কক্সবাজারবাসীর শত বছরের লালিত স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে প্রতীক্ষিত রেললাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে। রূপকল্প ২০২১ এর আওতায়
দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন প্রকল্পটি ইতোমধ্যে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। সব ঠিকঠাক থাকলে প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে কক্সবাজারবাসীর। সেই অপেক্ষার প্রহর গুনছি আমরা।’
জাফর আলম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই রেলপথ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ জন্য তৈরি করা নকশায় বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ যেসব স্থাপনা পড়েছে তাঁদের ক্ষতিপূরণসহ ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ উপযুক্ত মূল্য পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন। তাই এ নিয়ে কারো দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
প্রস্তাবিত নকশায় চকরিয়ার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পালাকাটা কুসুমকলি শিক্ষা নিকেতনের মাঝখান দিয়ে রেললাইন স্থাপনের কথা রয়েছে। ফলে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ভেঙে ফেলতে হবে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা দুশ্চিন্তায় আছেন।
পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবরে রেললাইন কর্তৃপক্ষের পাঁচ কর্মকর্তা এলাকা পরিদর্শনে আসেন। বিদ্যালয় সরিয়ে নিতে এখনো বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। তবে কয়েকদিন আগে চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হঠাৎ পরিদর্শনে এসে বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণের তাগাদা দেন।’
এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, ‘পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয় এবং কুসুমকলি শিক্ষা নিকেতন প্রস্তাবিত রেললাইনের নকশায় পড়েছে। তা ভেঙে ফেলা এবং নতুন করে ভবন নির্মাণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দেবে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেওয়া হবে বাকি চার হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। কালেরকন্ঠ
পাঠকের মতামত