জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে হল ছাড়ার পর উঠেছেন মিরপুর এক নম্বরে উঠেছেন আহমেদ হিমেল, চাকরি খুঁজছেন। সরকারি-বেসরকারি যে কোনো ভাল চাকরি বিজ্ঞাপন দেখলেই আবেদন করেন তিনি। পিএসসির কয়েকটি আবেদন ব্যাতীত প্রতিটি আবেদনপত্রে ছবি এবং সনদপত্রের ‘সত্যায়িত’ অনুলিপি চাওয়া হয়। প্রয়োজনীয় এ ‘সত্যায়িত’ করতে গিয়ে পাহাড়সম হয়রানি-দুর্ভোগে ভীষণ অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এ শহরে প্রথম শ্রেণির কোনো সরকারি কর্মকর্তা আমায় ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না। ফলে প্রতিটি আবেদনের জন্য সত্যায়িত আমার ছবি বা কাগজপত্র সত্যায়িত করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। অনেক অনুরোধ করার পর কেউ কেউ সত্যায়িত করে দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বিরক্তি প্রকাশ করে অপমানজনক কথা শুনিয়ে দেন। তাদের এ আচরণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি।
সত্যায়ন কেন?
চাকরি বা যে কোনো আবেদনপত্রে সত্যায়িত চাওয়া হয় কারণ আবেদনপত্রে আপনার দাখিলকৃত ডকুমেন্ট সত্যি কিনা অথবা আসল ডকুমেন্টের অনুলিপি কিনা সেটা একজন সাইন করে সাক্ষ্য দেবেন। স্বাক্ষী এমন ব্যক্তি হবেন যার সাক্ষ্য বিশ্বাস করার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা এক্ষেত্রে অষ্টম গ্রেড থেকে তদুর্ধ্ব, বিশেষ ক্ষেত্রে সাংসদ, মেয়র বা স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান, সরকারি অধ্যক্ষ, গণমাধ্যমের সম্পাদকসহ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সত্যায়নের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।
দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে ভুয়া সীল
দেশে লাখ লাখ চাকরি প্রার্থী রয়েছে যারা প্রতিদিন চাকরির আবেদন করার জন্য ছবি ও কাগজপত্র সত্যায়িত করতে ছোটেন সরকার নির্ধারিত প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের পিছনে। শিকার হন সীমাহীন দুর্ভোগের। শুধু চাকরিই নয়, দেশে শিশু থেকে বয়স্ক পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় সব নাগরিককে লেখাপড়া,পাসপোর্ট আবেদন, বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা নেওয়ার জন্য ছবি, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদসহ বিভিন্ন কাগজপত্র বাধ্যতামূলক সত্যায়িত করতে হয়।
সরকার নির্ধারিত প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার কাছে সত্যায়িত করতে গেলে ওই কর্মকর্তা ম্যানেজ করতে পারা রীতিমত ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হয়। এ সময় সরকারি ওই কর্মকর্তার কটূ কথা বা বাজে আচরণও হজম করতে হয়। এছাড়া অনেকেই আবার সত্যায়নের জন্য নির্দিষ্ট অংকের টাকা নিয়ে থাকেন। এসব ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়ে অনেকেই ভুয়া ‘সত্যায়িত’ সীল মোহর বানিয়ে জাল সই দিয়ে নিজের সত্যায়িত ‘নিজেই’ করেন।
ভুয়া সত্যায়ন ও সই জাল করার বিষয়ে আহমেদ হিমেল দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সম্প্রতি জাতীয় যাদুঘরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে আবেদনের জন্য ছবি ও কাগজপত্র সত্যায়িত করতে গিয়ে বাংলা কলেজের শিক্ষকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। আমাকে কেউ ‘চেনেন না’ বলে সত্যায়িত করাতে পারিনি। পরে বাধ্য হয়ে একটি ভুয়া সীল বানিয়েছি।
তিনি জানান, নীলক্ষেতসহ ঢাকা শহরের যে কোনো সীলপ্যাড তৈরীর দোকানে এসব ভুয়া সীল ৩০-৫০ টাকার বিনিময়ে তৈরী করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক চাকরিপ্রার্থী ভুয়া সত্যায়ন বিষয়ে বলেন, বেশিরভাগ সরকারি চাকরিসহ যে কোনো চাকরির ক্ষেত্রেই আবেদনের সঙ্গে ‘সত্যায়িত’ কাগজপত্র জমা দিতে হয়। কিন্তু বিসিএস কর্মকর্তাদের ধরে সত্যায়িত করার যে দুর্ভোগ তা থেকে বাঁচতে কখনো জালিয়াতির আশ্রয় নিতে হয়, যদিও সব কাগজপত্রই আসল।
সত্যায়ন এখতিয়ার পাওয়া ব্যক্তিরা যা বলেন
সত্যায়িত করতে দুর্ভোগ ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনীহার কারণেই প্রার্থীরা বাধ্য হয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে এমন অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সত্যায়ন করার এখতিয়ার ও সত্যায়ন করতে সরকারি নির্দেশের পরেও কেন সত্যায়িত করতে করতে চান না? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৮ বিসিএস এর একজন শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, অপরিচিত কারও ছবি বা কাগজপত্র ‘সত্যায়িত’ করার নিয়ম নেই। এ ক্ষেত্রে মূল কাগজপত্র উপস্থাপন করলেও ওই ব্যক্তি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত না হয়ে ‘সত্যায়িত’ করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওই ব্যক্তি যদি ‘সত্যায়িত’ করা কাগজপত্র নিয়ে কোনো রকম জালিয়াতির আশ্রয় নেন, এবং তা নিয়ে যদি বড় ধরনের কোনো বিপত্তির সৃষ্টি হয় তাহলে এর দায়ভার সম্পূর্নই এসে পড়বে আমাদের (সংশ্লিষ্ট ক্যাডার) ওপর। তাই ঝামেলা এড়াতে ‘সত্যায়িত’-এর ব্যাপারে আমরা একটু সচেতন থাকি।
তবে সত্যায়ন প্রার্থীদের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে ওই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, সত্যায়ন বিষয়ে সরকারের উচিৎ সহজ ও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এতে চাকরিপ্রার্থীরা অযাচিত বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাবেন।
বন্ধ হচ্ছে সত্যায়ন?
এদিকে সরকারি চাকরির আবেদনে হয়রানি কমাতে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সত্যায়ন বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়। তবে তা শুধু পিএসসি’র আবেদনের ক্ষেত্রেই মানা হয়।
সত্যায়ন বন্ধ করতে সচিব কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে একটি পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়। পরিপত্রে বলা হয়েছিল, `বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের শূন্যপদে নিয়োগসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীদের আবেদনপত্রের সঙ্গে নানা ধরনের কাগজপত্রের সত্যায়িত অনুলিপি চাওয়া হয়। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় এসব কাগজপত্রের সত্যায়িত অনুলিপি সংরক্ষণ ও পর্যালোচনা অনেক শ্রম এবং সময়সাপেক্ষ। এর পরিবর্তে আবেদনপত্রে আবেদনকারীর ছবি এবং প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত এক পাতার নির্ধারিত ফরমে আবেদন গ্রহণ ও মৌখিক পরীক্ষার সময় তথ্য যাচাই বাছাই করা হলে প্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে এবং নিয়োগপ্রক্রিয়াকরণ সহজ হবে।`
উক্ত পরিপত্র জারির পর থেকেই জনপ্রশাসন তথা পিএসসির কোনো আবেদনেই সত্যায়ন চাওয়া হয় না। তবে পিএসসির বাইরে সরকারি চাকরির যত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় তার প্রত্যেকটিতে সত্যায়ন চাওয়া হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) এর অধীনে ‘কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের জন্য রাবার ড্যামি নির্মাণ প্রকল্পে’, ‘ওয়ার্ক সুপারভাইজার’ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতেও কাগজপত্রে সত্যায়ন চাওয়া হয়েছে। সত্যায়নের যৌক্তিকতা জানতে চাইলে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের সচিব তুলশি রঞ্জন সাহা প্রিয়.কম’কে বলেন, চূড়ান্ত নিয়োগের সময় কাগজপত্র অবশ্যই যাচাই করে নেওয়া হয়। তারপরও সত্যায়ন করার বিষয়টি একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
সত্যায়নের বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, সব কাজে সত্যায়নের যে বাধ্যবাধকতা তা তুলে দেওয়া উচিত। সত্যায়িত করার প্রয়োজন হলে তা যেকোনো রেসপেকটেড পারসনও (সম্মানিত ব্যক্তি) করতে পারেন। জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, অনলাইনে শিক্ষা সনদ দেওয়া, পাসপোর্টসহ নাগরিক তথ্য ‘ডিজিটালাইজড’ হয়ে গেলে কয়েক বছর পর এসব সত্যায়নের আর প্রয়োজন হবে না।