ভারতে ‘চিকিৎসা’ করাতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এক সময়ের বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের পরিকল্পনায় তাকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বে দেন ভাড়াটে খুনি ও চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ। তার সঙ্গে আরও চারজন হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, গত ১৩ মে কলকাতার নিউ টাউন এলাকার সঞ্জীবনী গার্ডেনের অভিজাত একটি ফ্ল্যাটে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এরপর খুনিরা টুকরো করে লাশ গুম করে ফেলে। ওই ফ্ল্যাটটি আক্তারুজ্জামান ভাড়া নিয়েছিলেন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আনোয়ারুল আজিমের মরদেহের খোঁজ মেলেনি। ঢাকার পুলিশ সূত্রে মিলেছে এসব তথ্য।
হত্যা মিশন শেষ করেই আমানুল্লাহ ও শিলাস্তি রহমান নামে এক নারী ঢাকায় এসে আত্মগোপন করেন। এই শিলাস্তি রহমান হত্যার পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামানের বান্ধবী। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ওই দুজনসহ তিনজনকে আটক করেছে। এর পরই বেরিয়ে আসে এমপি আনোয়ারুল হত্যা রহস্য।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে কলকাতায় স্বর্ণের ব্যবসা ছিল সংসদ সদস্য আনারের। তারা দুজন সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি কারবারও নিয়ন্ত্রণ করতেন। চোরাই স্বর্ণের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। তবে পলাতক আক্তারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা গেলে হত্যার কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে। পাঁচ কোটি টাকার চুক্তিতে এই হত্যাকাণ্ড হয় বলে জানতে পেরেছে ডিবি। ঘটনার পর শাহীন দিল্লি হয়ে নেপাল চলে যান। তিনি মার্কিন পাসপোর্টধারী। ধারণা করা হচ্ছে, এরই মধ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। এমপি আনারের নিখোঁজ হওয়ার নেপথ্যে কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা পলাতক মুকুল বাহিনীর প্রধান আমিনুল ইসলাম মুকুলের হাত থাকতে পারে বলে অনেকে সন্দেহ করলেও পুলিশ তার সম্পৃক্ততা পায়নি।
গত ১২ মে চিকিৎসার কথা বলে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা-গেদে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যান আনার। ওইদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি কলকাতায় তার পূর্বপরিচিত বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন। গোপালের সঙ্গে তার ২৫ বছরের পারিবারিক সম্পর্ক। পরের দিন কলকাতার স্থানীয় সময় দুপুর ২টায় আনার চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা বলে গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বের হন। তখন গোপালকে বলে যান, তিনি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসবেন। এরপর আর বাসায় না ফেরায় ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় গোপাল বিশ্বাস একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর পর থেকে ঢাকা ও কলকাতা পুলিশ তার অবস্থান শনাক্তে কাজ করে আসছিল।
অবশ্য গতকাল ঢাকায় নিজ বাসভবনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারকে কলকাতার এক বাসায় পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। খুনের উদ্দেশ্য, কারা খুন করেছে, এসব জানতে ভারতের পুলিশ কাজ করছে। এই খুনের সঙ্গে বাংলাদেশিরাই জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঘটনায় জড়িত তিনজনকে এরই মধ্যে আটক করা হয়েছে। আরও কয়েকজনকে ধরার চেষ্টা চলছে।
ওই সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আরও কয়েকজনকে ধরার চেষ্টায় আছি। এটা খুন। তাকে (আনার) হত্যা করা হয়েছে। এখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরবে, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কারণ, ভারতের কেউ এখানে জড়িত নন। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে আমাদের দেশের মানুষই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে, তা তদন্তের স্বার্থে এখনই প্রকাশ করছি না। তদন্ত শেষ হলে জানানো হবে, তিনি কেন খুন হয়েছেন, কে কে খুন করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে।’
মরদেহ এখনো আসেনি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, দুই দেশের পুলিশ তদন্ত করছে। ভারতের পুলিশ আমাদের জানিয়েছে যে, তিনি খুন হয়েছেন, এটা নিশ্চিত।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল এক শোকবার্তায় শেখ হাসিনা মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
আনারকে হত্যার ঘটনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, এমপি আনোয়ারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত মূলহোতাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। কলকাতা পুলিশও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আমরা আমাদের মিশনের মাধ্যমে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি। আমাদের মিশনও কলকাতা পুলিশের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে। তিনি বলেন, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যার ঘটনা খুবই দুঃখজনক, মর্মান্তিক ও অনভিপ্রেত। বিষয়টি তদন্তাধীন।
এদিকে গতকাল বিকেলে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছেন আনোয়ারুল আজিমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়।
কে এই আক্তারুজ্জামান: তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ডিবি সূত্র জানায়, হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন। তিনি এমপি আনারের বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার। এই আক্তারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এবং মার্কিন পাসপোর্টধারী। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে তার বাড়ি। কোটচাঁদপুরের পৌর মেয়র শহিদুজ্জামান সেলিমের ছোট ভাই তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মার্কিন পাসপোর্টে তার নাম মো. আক্তারুজ্জামান, পাসপোর্ট নম্বর ইউএসএ ৫৬৬৮৩৩১৯৭। ঝিনাইদহের স্থানীয় সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাকারবারি চক্রের সঙ্গে যুক্ত এই শাহীন। এমপি আনারের সঙ্গে তার সখ্য এবং দুজন মিলেই সীমান্তের চোরাচালান চক্র নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। সর্বশেষ গত ১০ মে কলকাতা থেকে শাহীন বাংলাদেশে এসে কোটচাঁদপুরে যান।
গোয়েন্দা ও স্থানীয় সূত্র জানায়, এমপি আনারের সঙ্গে শাহীনের স্বর্ণের বড় একটি চালান নিয়ে ঝামেলা চলছিল। এমপি ওই চালানের টাকা শাহীনকে দেননি। এটা নিয়ে দীর্ঘ ঝামেলার পর মূলত কলকাতায় অন্যান্য পার্টনারের সঙ্গে মীমাংসার জন্য যান এমপি আনার। মূলত তাকে এক নারী দিয়ে ফাঁদে ফেলে কলকাতায় নেওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানান, শাহীন তার ভাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মনিরুজ্জামান মনার মাধ্যমে অন্তত ২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হন। সেখানে বসেই দেশে স্বর্ণ ও অস্ত্র কারবার নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। কোটচাঁদপুরের অদূরে এলাঙ্গী গ্রামে তার একটি বাগানবাড়ি রয়েছে। দেশে এলে সেখানে বসত মদের আসর। সেখানেই পরিকল্পনা হতো স্বর্ণ ও অস্ত্র কারবারের।
আমানুল্লাহ আমানের পরিচয়: ডিবি সূত্র জানায়, আক্তারুজ্জামান শাহীন এমপি আনারকে হত্যার জন্য আমানুল্লাহর সঙ্গে ৫ কোটি টাকায় চুক্তি করেন। এই আমানুল্লাহ এক সময় চরমপন্থি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। যশোরের অভয়নগরে গণেশ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সাত বছর জেল খাটেন। ইমান আলী নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন আমানুল্লাহ। দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসী এখন ডিবি হেফাজতে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আমানুল্লাহ সমাজের অনেক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় থাকার কারণে তাকে বিভিন্ন কারণে নানা সময় উচ্চশ্রেণির লোকজন ভাড়া করতেন। আক্তারুজ্জামান শাহীন আমানুল্লাহকে ভাড়া করার পর এই আমানুল্লাহ অন্য কিলার মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল সাহাজিকে রিক্রুট করেন। শাহীন আগে থেকেই ভারতে জিহাদ এবং সিয়ামকে রিক্রুট করে রাখেন। জিহাদ এবং সিয়ামের কোনো পাসপোর্ট নেই। তারা অবৈধপথে ভারতে যাওয়া-আসা করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, মূল পরিকল্পনাকারী শাহীন এবং আমানুল্লাহ ৩০ এপ্রিল কলকাতায় যান। হত্যার সবকিছু ঠিকঠাক করে শাহীন ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন। আমানুল্লাহ সেখানে থেকে যান।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর ১৫ মে শাহীনের বান্ধবী শিলাস্তি রহমান এবং আমানুল্লাহ বিমানে ঢাকায় চলে আসেন। এর পরই তাদের অবস্থান শনাক্ত করে আটক করা হয়।
পরিকল্পিত হত্যার প্রমাণ পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ: পরিকল্পিতভাবে আনারকে যে হত্যা করা হয়েছে, তার প্রমাণ পেয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। তবে তার মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি। এ ঘটনার তদন্ত করছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির মহাপরিদর্শক অখিলেশ চতুর্বেদী বলেছেন, ‘আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি, যার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে যে ওনাকে হত্যা করা হয়েছে।’
তিনি জানান, পূর্ব কলকাতার নিউ টাউন অঞ্চলে যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজিম আনার উঠেছিলেন, সেটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরের কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার রায়ের। সন্দীপের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি। আকতারুজ্জামানই ওই ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজিমের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কলকাতার নিউ টাউনের অভিজাত আবাসিক এলাকা সঞ্জীবনী গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটে গতকাল তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। সেখানে কী ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে বা রক্তের দাগ পাওয়া গেছে কি না, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু জানাননি অখিলেশ চতুর্বেদী। তিনি বলেছেন, পুলিশের ফরেনসিক বিভাগ তদন্তের কাজ শুরু করেছে। তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আনারের সঙ্গে কয়েকজন ব্যক্তি এই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন জানিয়ে অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, ‘কিন্তু তারা কবে বেরিয়ে গেলেন, সে বিষয়ে আমরা তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে পারছি না। এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, ১৩ মে তিনি এখানে এসেছিলেন। তবে তার আগেও এসেছিলেন কি না, সেটা আমরা এখনো জানি না।’
আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করে দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়েছে কি না, সে বিষয়েও কিছু বলতে চাননি সিআইডি প্রধান। সুত্র: কালবেলা