প্রক্টরিয়াল বডি মানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক নিয়ে গঠিত একটি টিম, যারা শিক্ষার্থীদের মধ্যকার শৃঙখলা আনার কাজটি করেন। অস্থির ছাত্র রাজনীতি, দ্বন্দ্ব ও শিক্ষার্থীদের পরস্পরের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমন বা ছাত্রদের যেকোন সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে নিয়ে সচেতন থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব এই শিক্ষকদেরই।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ হাজার সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কাজের ক্ষেত্র অনেকটাই অপ্রাতিষ্ঠানিক ও চ্যালেঞ্জিং। এ কারণেই অনেকে বিশ্বাস করতে চান এ চ্যালেঞ্জ কেবল পুরুষ শিক্ষকরাই নিতে পারবেন।চিরায়ত এ ধারণাকে একেবারেই গুঁড়িয়ে দিলেন দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সহকারী প্রক্টর মরিয়ম ইসলাম লিজা।
২০১৯ সালের ৮ জুলাই তাকে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব দেন একই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রথম নারী উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার। এই একবছরে তিনি দেখিয়েছেন— কোন দায়িত্বই নারী বা পুরুষের হয় না। কাজের লিঙ্গ নেই। দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও সদিচ্ছা থাকলে কাজ যাই হোক-সফল হওয়া সম্ভব।
এসব বিষয় নিয়ে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন আমাদের জাতীয় অনলাইন পত্রিকার প্রতিবেদকের সাথে। যার চুম্বন অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:
প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তারপর শিক্ষক হওয়া। এরপর শিক্ষার্থীদেরই শৃঙখলা রক্ষার প্রশাসনিক দায়িত্ব পেলেন। দায়িত্বটা নিয়ে প্রথম কেমন অনুভূতি হল আপনার?
মরিয়ম ইসলাম লিজা: আসলে এ পদটির দায়িত্বগুলোর মৌলিক একটি বিষয়ে আমি বেশি মনোযোগ দিয়েছি সেটা হল শিক্ষার্থীদের পরস্পর ও ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের মেলবন্ধন তৈরি করা। প্রথমে শিক্ষার্থী, পরে শিক্ষক হওয়া ও প্রশাসনিক দায়িত্ব নেওয়া আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর প্রথমে হতে হয় বন্ধু। শিক্ষার্থীদের একটা কমফোর্ট জোন দিতে হয়, যাতে সমস্যার কথা সংকোচ ছাড়াই তারা বলতে পারে। অভিভাবক হওয়ার আগে আমি তাদের বন্ধু হতে চেয়েছি। অনভূতিটাও খুব ভাল, কারণ আমি একইরকমের ফিডব্যাক পেয়েছি শিক্ষার্থীদের কাছে।
প্রতিবেদক: এই দায়িত্বটা আগে শুধু পুরুষরাই পালন করত। প্রথম নারী সহকারী প্রক্টর হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বকে কিভাবে পালন করলেন?
মরিয়ম ইসলাম লিজা: প্রথমত আমি এমন পরিবারে বড় হয়েছি যেখানে নারীর কাজ পুরুষের কাজ আলাদা করে দেখা হয় না। আমিও মনে করি না কোন কাজ নারী বা পুরুষের বলে বিশেষায়িত হতে পারে। আইনশৃংখলা রক্ষার কাজের কথা যদি বলেন— আমি বিষয়টিকে এভাবে দেখি কোন একটি ঘটনা ঘটবার আগেই যেন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমি ঠিক সেভাবেই এগিয়েছি। আমি কম্যান্ডিং অ্যাকশনে যাওয়ার আগে লক্ষ্য রেখেছি যেন আগে ভাগে ইস্যুগুলোকে সমাধান করে দেওয়া, যাতে বড় কিছু ঘটতে না পারে। তাই আমি দায়িত্ব পালনের সময় বড় কোন চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটতে পারেনি। যদি নারী পুরুষ তুলনা করতে চান বলব-ইনশাল্লাহ, আমি নিজের ইফোর্ট ১০ পার্সেন্ট বেশিই দিয়েছি। আরেকটি বিষয় আমি বলতে চাই ভবিষ্যতে প্রক্টরিয়াল বডিতে আরও নারী শিক্ষক সংযুক্ত হওয়া উচিত।
প্রতিবেদক: অনেকেই ভাবে এটা একটু ক্ষমতা চর্চার পদ, ছাত্রছাত্রীরা এ পদে থাকা শিক্ষকদের মেনে চলারও বিষয় রয়েছে— নারী হিসেবে প্রথম এমন পদে এসে কী কী চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে?
মরিয়ম ইসলাম লিজা: কথাটিকে আমি চ্যালেঞ্জ বলতে চাই না। আমি বলি কাজের ফিল্ড তৈরি করা। কাজের জায়গাটুকু আমার ভাললাগার। পদটাকে আমি মোটেও ক্ষমতা চর্চার জায়গা মনে করিনি। প্রথমেই বলেছিলাম একটা ফিল্ড তৈরি করতে হয় সেটা হল ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক থাকা। পৃথিবীতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কটিকে আমার সবচেয়ে স্বার্থহীন ও সুন্দর সম্পর্ক বলে মনে হয়। এই মেলবন্ধনের প্লাটফর্মটি যখন তৈরি হয়ে যায়, তখন আমার বিধিনিষেধও তাদের মেনে নিতে সমস্যা হয় না। এটি আমার একটি প্রাপ্তির জায়গা বলতে পারেন। আমি মনে করি মেয়েদের বায়োলজিক্যালি সমস্যা সমাধানের দূরদর্শিতা থাকে। কাজকে আমি কাজের মত করেছি নিজের সর্বোচ্চ ইফোর্ট দিয়ে। চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিইনি।
প্রতিবেদক: ধরুন গভীর রাতে ছাত্ররা হলে সংঘর্ষ বাধালো, বা কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটল— তখন বিষয়টা কিভাবে সমাধান করেন?
মরিয়ম ইসলাম লিজা: গত একবছরে খুব বড় বা সেন্সিটিভ কোন সংঘর্ষ বাঁধেনি। আমি শুরু থেকেই চেয়েছি উভয়পক্ষের কথা শুনে যাকে যা বলার বা বোঝানোর সেটা বলেই বুঝিয়েছি। আমি নিয়মিতই তাদের খোঁজ রাখি। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মানসিকভাবে পুরোপুরি পক্ক বলা যায় না। তারা এখানে শিখতে আসে। তাদের জানার আগ্রহ প্রবল। এখন তাদের ভুল করার বয়স। ওরা ভুল করবেই। আমরাই যেন ওদের ঠিকভাবে গাইড দিতে পারি সেটা লক্ষ্য রাখা বেশি জরুরি। আমি ঠিক তাই করেছি। তবে রাতে বা দিনে হলে বা অন্যকোথাও সমস্যা হলে আমি গিয়েই সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি।
একটা ঘটনা বলি, রাতে একবার দুর্ঘটনার খবর পেয়েছিলাম। আমাদের একটি বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। রাত তখন এগারোটা। আমি মাত্র বাসায় এসে পৌঁছেছিলাম। আবার খবর পেয়েই হাসপাতালে চলে গেলাম। অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরা বলেছিলেন তারা আসার আগেই আমি পৌঁছেছি। খুব অ্যাপ্রিসেয়েশন পেয়েছিলাম। এগুলোকেই প্রাপ্তি ভাবি আমি।
প্রতিবেদক: নারী হিসেবে এ দায়িত্ব নেওয়ার সময় কোন কটু কথা বা বিরুপ মন্তব্য সহ্য করতে হয়েছে কী না?
মরিয়ম ইসলাম লিজা: দেখুন আপনিও একজন নারী। বুঝতেই পারছেন। মনে রাখবেন, ভাল কাজ করলে কটু কথা বা বিরুপ মন্তব্য শুনতেই হবে। শুনতে হয়েছে। মানুষ যা দেখে অভ্যস্ত নয় তা হলে প্রাথমিকভাবে মেনে নিতে পারে না। ধরুন, মাঠে এক’শ জন মারামারি করছে। ওইখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে সমস্যা সমাধান করবে এমন দৃশ্যে অভ্যস্ত নয় আমাদের সমাজ। আমি সেসব কানে নিইনি। আমি আমার কাজেই ফোকাস করেছি। তবে কাজটি যখন করেই ফেললাম এখন সবাই বরং অভিবাদন জানাচ্ছে। সেটাই মুখ্য। কারও বলাটা তুচ্ছ হয়ে যায় যখন আমরা কাজে সফল হই।
প্রতিবেদক: সহকারী প্রক্টর পদে একজন নারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে নারী শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে কী ভূমিকা রেখেছেন?
মরিয়ম ইসলাম লিজা: কতটা পেরেছি সেটা বলছি না। চেষ্টা করেছি ম্যান টু ম্যান কানেক্টেড হতে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা নিজে গিয়ে জানতে চেয়েছি। যেকোন সমস্যা আমাকে যেন জানাতে পারে, সেটুকু সুযোগ তাদের দেওয়ার চেষ্টা করেছি। রাত হোক বা দিন তাদের সমস্যার কথা জানতেই সমাধান করার চেষ্টা করেছি। এমনও হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনা হলের নির্মাণ কাজ দেরি হওয়ায় ছাত্রীরা উঠতে পারছিল না। তাদের কষ্ট হচ্ছিল বেশ। এ নিয়ে আন্দোলনও করেছিল মেয়েরা। ভিসি ম্যামের নির্দেশনা নিয়ে আমিই এ হলের কাজ দ্রুত শেষ করতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। নিজে সরাসরি বিষয়গুলো মেন্টেন করেছি। মেয়েদের শান্ত রেখে, বুঝিয়ে তাদের এই সমস্যার সমাধান করেছি।
প্রতিবেদক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃংখলা রক্ষায় সবচেয়ে বড় বাধা কী? বা ছাত্ররাজনীতিকে কী বাধা হিসেবে দেখেছেন?
মরিয়ম ইসলাম লিজা: দেখুন আমি মনে করি, ছাত্র রাজনীতি হল বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য। রাজনীতিতে মানুষের অংশগ্রহণের মৌলিক শিক্ষাটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পায় শিক্ষার্থীরা। ছাত্র-ছাত্রীরা বয়সে ছোট। তারা ভুল করবে, করতে পারে সেটা বুঝতে হবে আমাদের। মাথা ব্যথার সমস্যায় তো মাথা কেটে ফেলা নয়, তাই না? আমি রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়াও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কাজগুলোর দিকে লক্ষ্য রেখেছি। তাদের গাইড করার চেষ্টা করি, যেন দ্বন্দ্ব না বাঁধে। ছাত্ররাজনীতিকে আমি বাধা হিসেবে দেখি না কখনোই।
প্রতিবেদক: ভবিষ্যতে এমন পদে আরও নারী শিক্ষক এগিয়ে আসবেন বা সুযোগ পাবেন বলে মনে করেন কী?
মরিয়ম ইসলাম লিজা: অবশ্যই চাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীলতা ও মুক্ত চিন্তা চর্চার জায়গা, গোঁড়ামির নয়। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী তিনি দেশ পরিচালনায় সফলদের অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করছেন। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে পিছপা হওয়ার কথা ভাবছি না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার ম্যামকে আমরা পেয়েছি। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিচ্ছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ প্রক্টর হিসেবেও একজন নারী শিক্ষক আসেন, এমনটাই কামনা করি আমি।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের সহকারী অধ্যাপক মরিয়ম ইসলাম লিজা ‘শিশু প্রতিভা বিকাশ কেন্দ্র’ নামে একটি এনজিওর উপদেষ্টা পদেও রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত তার স্বামী সৈয়দ শামসুল তাবরীজ কক্সবাজারের চকরিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।